মঙ্গলবার ৫ আগস্ট ২০২৫ - ১৯:০৪
আরব দেশগুলোর শিয়া-ভীতি বা “শিয়া-ফোবিয়া” তৈরির কারণ

ইসলাম একটি ঐক্যের ধর্ম। কিন্তু ইতিহাসজুড়ে কিছু রাজনৈতিক শক্তি ইসলামের নাম ব্যবহার করে উম্মাহকে বিভক্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলো—বিশেষত সৌদি আরব ও তার মিত্ররা—বিস্তর অর্থ ও প্রচারণা বিনিয়োগ করে শিয়া ইসলাম এবং ইরানবিরোধী একটি ভয় বা “শিয়া-ফোবিয়া” তৈরি করেছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করবো এই ভীতির মূল কারণ, এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর বিপরীতে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি।

১. কুরআনের আলোকে মুসলিমদের প্রতি ঐক্যের নির্দেশ
ইসলামে বিভেদ নিষিদ্ধ এবং ঐক্যকে ঈমানের শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।” [সূরা আলে ইমরান: ১০৩]

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“নিশ্চয়ই মুমিনগণ একে অপরের ভাই।” [সূরা হুজুরাত: ১০]

অথচ শিয়া-ভীতি ছড়িয়ে এই কুরআনি নির্দেশনার প্রকাশ্য লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

২. হাদীসের আলোকে আহলে বাইত ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা
রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মাহকে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন:
إِنِّي تَارِكٌ فِيكُمُ الثَّقَلَيْنِ: كِتَابَ اللَّهِ، وَعِتْرَتِي أَهْلَ بَيْتِي، وَلَنْ يَفْتَرِقَا حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْضَ
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি ভারী জিনিস রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত। এ দুটি কখনো আলাদা হবে না যতক্ষণ না হাউজে কাওসারে আমার কাছে পৌঁছায়।” [সহীহ মুসলিম, তিরমিযি, মুসনাদে আহমাদ]

শিয়া মুসলিমরা এই আহলে বাইতের পথকে অনুসরণ করে। অথচ রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।

৩. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ইসলামি বিপ্লব ও রাজতন্ত্রের আতঙ্ক
ইরানের ইসলামি বিপ্লব (১৯৭৯) ঘোষণা করেছিল: “আমরা দুঃস্থের পক্ষে, জালিমের বিরুদ্ধে; আমরা বিশ্ব মুসলিমদের ঐক্য চাই।”

এই বিপ্লব রাজতন্ত্র, পশ্চিমা দালালি ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিন ও মজলুমদের পক্ষে শক্ত আওয়াজ তোলে। ফলে সৌদি নেতৃত্বাধীন রাজতন্ত্র এই বিপ্লবের বিপ্লবী চেতনা থেকে জনগণকে দূরে রাখতে, ‘শিয়া’ নাম দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

৪. শিয়া-ভীতির প্রোপাগান্ডা: মিডিয়া, মসজিদ ও দারুল উলুম
সৌদি আরব ও তার মিত্ররা শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে: শিয়া বিদ্বেষমূলক বই, খুতবা ও ভিডিও তৈরি করে, উপমহাদেশে শত শত মাদ্রাসা ও মিডিয়া চ্যানেলকে অর্থায়ন করে, ইউরোপ ও আমেরিকাতেও ‘আন্তর্জাতিক শিয়া বিরোধী সম্মেলন’ করে।

এর পেছনে লক্ষ্য হলো: “শিয়ারা বিপথগামী”, “ইরান বিশ্ব দখল করতে চায়”, “শিয়ারা মুসলমান নয়” “শিয়ারা  মুশরিক” “শিয়ারা আলীকে আল্লাহ বলে” “শিয়ারা সাহাবীদের সমালোচনা করে”— এইসব প্রচারণা চালিয়ে উম্মাহকে বিভক্ত রাখা।

৫. ফিলিস্তিন ও প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
শিয়া মুসলিমরা একমাত্র গোষ্ঠী যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেয়:

১. হিজবুল্লাহ (লেবানন)

২. আনসারুল্লাহ (ইয়েমেন)

৩. ইরানি বিপ্লবী গার্ড (IRGC)

৪. ইরাকের হাশদ আশ-শাবি

তাই ইসরায়েল চায় মুসলমানরা তাদেরকে “শিয়া সন্ত্রাসী” মনে করুক এবং প্রতিরোধের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিক।

৬. ইসলামি ঐক্য ধ্বংস: পশ্চিমা স্বার্থরক্ষা
মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হলে:
-ইসরায়েল ধ্বংস হবে,
-ফিলিস্তিন মুক্ত হবে,
-আরব রাজতন্ত্রের পতন হবে।

তাই শিয়া-সুন্নি বিভক্তি একটি অস্ত্র—যার সাহায্যে:

- মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগানো যায় (যেমন ইয়েমেন),

- শত্রুর হাতে অস্ত্র কেনা যায় (ইরান ভয় দেখিয়ে),

- উম্মাহর অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধ্বংস করা যায়।

উপসংহার: শিয়া-ভীতি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যার লক্ষ্য ইসলামের মূল শিক্ষা—ঐক্য, ইনসাফ, প্রতিরোধ ও আহলে বাইতের মর্যাদা—ধ্বংস করা।

কিন্তু কুরআন ও হাদীসের প্রকৃত বার্তা বলছে:
وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَىٰ إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا
“যে ব্যক্তি তোমাদেরকে সালাম করে, তাকে বলো না ‘তুমি মুমিন নও’।” [সূরা নিসা: ৯৪]

আজ উম্মাহর দায়িত্ব—শত্রুর তৈরি এই বিভক্তি ভেঙে দিয়ে ইসলামের মূল আলোচ্য বিষয়—আহলে বাইতের আদর্শ, ইনসাফ, জুলুমবিরোধিতা ও ঐক্য—কে সামনে আনা।

উল্লেখযোগ্য সূত্রসমূহ:

১. আল-কুরআন: সূরা আলে ইমরান, হুজুরাত, নিসা

২. সহীহ মুসলিম, তিরমিযি, মুসনাদে আহমাদ

৩. WilayatNet, Al-Akhbar (Lebanon), Al-Monitor

৪. Imam Khomeini's Writings

৫. Saudi–US Relations Archives

৬. Sayyed Hasan Nasrallah’s speeches

৬. Academic works on Sectarianism: Vali Nasr, “The Shia Revival”

লিখেছেন: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব আলী নওয়াজ খান 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha