হাওজা নিউজ এজেন্সি: হাজী ইসমাইল দোলাবি (রহ.) বলেন, একজন পিতা ছিলেন, যাঁর চারজন সন্তান। একদিন তিনি তাদের একটি ঘরে রেখে বললেন, “তোমরা এখানে থাকো, আমি যাচ্ছি, পরে ফিরে আসব।” পিতা বাইরে গেলেন, কিন্তু আসলে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের সব আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন।
প্রথম পুত্র – অবাধ্য ও ধ্বংসসৃষ্টিকারী
প্রথম সন্তান পিতার অনুপস্থিতিকে সুযোগ ভেবে বিশৃঙ্খলা শুরু করল। ঘর ভেঙে ফেলল, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলল, আর অবাধে আচরণ করল। সে ভাবল — “পিতা তো নেই, এখন আমি স্বাধীন!” এই সন্তান সেই শ্রেণির প্রতীক যারা শেষ যুগে নৈতিকতা হারিয়ে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করবে। তারা ঈমানের কাঠামো ধ্বংস করবে এবং অন্যদের বিভ্রান্ত করবে।
দ্বিতীয় পুত্র – আবেগপ্রবণ কিন্তু নিষ্ক্রিয়
দ্বিতীয় পুত্র দেখল ঘর ভাঙছে, বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। সে কাঁদতে শুরু করল — “বাবা এসো! বাবা ফিরে এসো!” কিন্তু সে নিজে কোনো পদক্ষেপ নিল না। এই শ্রেণি সেইসব মানুষকে বোঝায়, যারা শুধু বিলাপ ও প্রার্থনা করে, কিন্তু দায়িত্ব পালন করে না। তারা ইমামের জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু তাঁর আগমনের প্রস্তুতি নেয় না।
তৃতীয় পুত্র – সম্পূর্ণ গাফেল
তৃতীয় সন্তান পিতাকে একেবারেই ভুলে গেল। সে নিজের খেলায়, কাজে ও আনন্দে মগ্ন হয়ে পড়ল।
পিতা আছে কি নেই — তার কোনো গুরুত্বই তার কাছে রইল না। এই সন্তান সেইসব মানুষকে প্রতীকায়িত করে, যারা আল্লাহ, নবী ও ইমামের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার মোহে হারিয়ে যায়। তারা নিজেদের জীবনকে শুধু ভোগ ও স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে।
চতুর্থ পুত্র – সচেতন, দায়িত্বশীল ও আশাবাদী
শেষ পুত্র জানত — পিতা তাঁকে দেখছেন, যদিও সামনে নেই। সে ঘর পরিষ্কার করল, ভাঙা জিনিসগুলো ঠিক করল, এবং নিজের দায়িত্ব পালন করতে লাগল। সে বলল, “যত দেরিতেই বাবা আসুন না কেন, আমি কাজ চালিয়ে যাব, কারণ জানি তিনি আমার প্রতিটি কাজ দেখছেন।”
এই সন্তান সেইসব মানুষের প্রতীক, যারা ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়েব অবস্থায়ও তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ও আস্থা রাখে। তারা সমাজে ন্যায়, সততা, সেবা ও আধ্যাত্মিকতা বজায় রাখে। তারা শুধু দোয়া করে না, বরং বাস্তব জীবনে আল্লাহর প্রতিনিধির সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে যায়।
হাজী দোলাবি (রহ.)-এর ব্যাখ্যা: “আমরাই সেই চার সন্তান”
হাজি দোলাবি (রহ.) বলেন, “এই গল্পটি আসলে আমাদের বর্তমান যুগের প্রতিচ্ছবি। কিছু মানুষ সমাজকে ধ্বংস করছে; কিছু মানুষ কেবল আহাজারি করছে — ‘ইমাম আসুন! মাওলা ফিরে আসুন!’; কিছু মানুষ সম্পূর্ণভাবে গাফেল হয়ে দুনিয়ার মোহে ডুবে গেছে; আর কিছু মানুষ আছেন, যারা ইমাম মাহদী (আ.)-এর সন্তুষ্টির জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি জানে তার প্রভু তাকে দেখছেন, সে কখনো গাফেল হতে পারে না। এমনকি যদি ইমামের আগমন বিলম্বিতও হয়, সে আরও বেশি উদ্যমে কাজ করে, কারণ সে জানে, প্রতিটি নিঃশ্বাস ও কর্ম তাঁর দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত।”
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
এই গল্পটি আমাদের শেখায় —“ইন্তেজার” (প্রতীক্ষা) মানে নিস্ক্রিয়ভাবে বসে থাকা নয়। বরং এটি একটি সক্রিয়, সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ জীবনযাপন। যে সত্যিকার অর্থে ইমামের প্রতীক্ষা করে, সে নিজের ঘর, সমাজ ও আত্মাকে এমনভাবে প্রস্তুত রাখে যাতে ইমামের আগমন তার মধ্যে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ঘটাতে পারে।
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, “প্রত্যেক অপেক্ষাকারীর কাজ তার প্রতীক্ষার মান নির্ধারণ করে।” অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সত্যিকার ইন্তেজারকারী, তার জীবনেই প্রতিফলিত হয় ইমামের ন্যায়ের রূপরেখা।
হাজী ইসমাইল দোলাবি (রহ.)-এর এই প্রতীকী ব্যাখ্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় —আখিরুযযামান কেবল ভয় বা ধ্বংসের সময় নয়; এটি পরীক্ষা ও চেনার সময়।মানুষ তখন চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত হবে: অন্যায়কারী, বিলাপকারী, গাফেল ও কর্মঠ প্রতীক্ষাকারী। ইমাম মাহদী (আ.)-এর প্রকৃত অনুসারী সেই ব্যক্তি, যিনি গায়ব অবস্থাতেও তাঁর দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকেন এবং সমাজকে আলোকিত করেন।
আপনার কমেন্ট