শনিবার ১ নভেম্বর ২০২৫ - ০৮:১৪
ইসরায়েলকে মোকাবিলার নির্দেশ লেবানিজ প্রেসিডেন্টের, সেনাবাহিনী কি আদৌ প্রস্তুত?

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের ব্লেইদা এলাকায় ইসরায়েলি সেনাদের সাম্প্রতিক হামলায় এক পৌর কর্মচারী নিহত হওয়ার পর লেবাননের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জোসেফ আউন এক নজিরবিহীন নির্দেশ জারি করেছেন। তাঁর নির্দেশে বলা হয়েছে— ইসরায়েলি যেকোনো অনুপ্রবেশ বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এতে ব্লেইদা শহরের পৌর কার্যালয়ের কর্মচারী ইব্রাহিম সালামা নিহত হন। ঘটনার পর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ চালায়। তেলআবিব দাবি করে— তারা নাকি “হিজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো” লক্ষ্যবস্তু করেছে।

ঘটনার পরপরই প্রেসিডেন্ট আউনের নির্দেশ লেবাননের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ, বহু বছর পর লেবাননের রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি সেনাবাহিনীকে সীমান্ত প্রতিরোধে নামার নির্দেশ দিলেন— এমনটি আগে খুব কমই ঘটেছে।

কেন এই নির্দেশ গুরুত্বপূর্ণ?
লেবাননের সেনাবাহিনী গত কয়েক দশক ধরে সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো বড় যুদ্ধে জড়ায়নি। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে মূলত হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য প্রতিরোধ ফ্রন্ট।
সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ও অবকাঠামো ইসরায়েলের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাদের হাতে পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র, প্রযুক্তি ও আর্থিক সামর্থ্যও সীমিত। এ কারণে প্রেসিডেন্টের নির্দেশটিকে অনেকে “রাজনৈতিক অবস্থান” হিসেবেও দেখছেন— যা জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রকাশ।

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া: ‘এটি সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’
লেবাননের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে ব্লেইদা হামলাকে “অপরাধমূলক, সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের প্রকাশ্য অবমাননা” হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বিবৃতিতে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কমিটিকে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

লেবাননের সামরিক মুখপাত্র জানান, সেনাবাহিনী দেশের প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত সুরক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে, তবে তারা সংঘাত নয়, শান্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে কাজ করছে।

লেবাননের সামরিক সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
লেবাননের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব একমাত্র সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্র লেবানন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় আর্থিক ও প্রশিক্ষণ সহায়তাকারী। তারা সেনাসদস্যদের বেতন, হালকা অস্ত্র সরবরাহ এবং কিছু লজিস্টিক সেবা দিয়ে থাকে।

সামরিক সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে লেবাননের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীতে মোট প্রায় ৫০,০০০ সদস্য রয়েছে। তাদের কাছে কোনো যুদ্ধবিমান নেই; হাতে থাকা প্রায় ৭০টি হেলিকপ্টারের বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয় উদ্ধার, প্রশিক্ষণ ও অগ্নিনির্বাপণের কাজে।
স্থলবাহিনীতে রয়েছে প্রায় ২০০ ট্যাঙ্ক ও কয়েক হাজার সাঁজোয়া যান, যেগুলোর অধিকাংশই সোভিয়েত আমলের পুরোনো মডেল।

ইসরায়েলিদের দৃষ্টিতে লেবাননের সেনাবাহিনী
ইসরায়েলের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আসাফ ওরিয়ন লেবাননের সেনাবাহিনীকে “একটি বশীভূত বাহিনী” হিসেবে উল্লেখ করেছেন— যা পশ্চিমা শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় টিকে আছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আলমা সেন্টার-এর গবেষণা বিভাগের প্রধান তাল বেইরি বলেন, “লেবাননের সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র এতটাই পুরোনো ও সীমিত যে, তারা ইসরায়েলের জন্য বাস্তব কোনো সামরিক হুমকি নয়।”

উত্তেজনা নাকি রাজনৈতিক বার্তা?
এই ঘটনাগুলো ঘটছে এমন এক সময়ে যখন লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে, এবং গত নভেম্বরের ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ঘেরা।

এ অবস্থায় বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন— প্রেসিডেন্ট আউনের নির্দেশ কি ইসরায়েলকে সরাসরি সামরিকভাবে চ্যালেঞ্জ করার ইঙ্গিত, নাকি এটি কেবল একটি রাজনৈতিক বার্তা, যার উদ্দেশ্য লেবাননের সার্বভৌম অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা?

কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই নির্দেশ বাস্তবে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতির আহ্বান নয়; বরং ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের প্রতি একটি সতর্কবার্তা, যাতে লেবাননের জনগণ ও রাষ্ট্র একসঙ্গে অবস্থান করছে— এমন বার্তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া যায়।

লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে যুদ্ধের ছায়া এখন আরও ঘন হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ সেনাবাহিনীর মনোবলকে সাময়িকভাবে উজ্জীবিত করলেও বাস্তব যুদ্ধের ময়দানে দেশটি কতটা প্রস্তুত— সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সময়ই বলে দেবে, লেবানন সত্যিই যুদ্ধের পথে যাচ্ছে কিনা, নাকি রাজনৈতিক কূটনীতি ও প্রতিরোধের ভারসাম্য বজায় রেখেই চলবে আগামী দিনগুলো।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha