বুধবার ১২ নভেম্বর ২০২৫ - ১৯:৪৭
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জনক: শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম

আজ ১২ নভেম্বর শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের শাহাদাতের ১৪তম বার্ষিকী। তাঁকে “ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জনক” এবং এক দূরদর্শী সামরিক কৌশলবিদ হিসেবে স্মরণ করা হয়, যিনি তাঁর যুগের অনেক আগেই ভবিষ্যৎ যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা কৌশলের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ১৯৮০-এর দশকের আরোপিত ইরান–ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি ইরানের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং বহু বিশিষ্ট মহাকাশ ও বিমান কমান্ডারকে প্রশিক্ষণ দেন, যারা আজও তাঁর মিশন ও আদর্শ বহন করে চলেছেন।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন
হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম ১৯৫৯ সালে তেহরানের কেন্দ্রস্থলের সারচেশমেহ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

এরপর ১৯৭৯ সালে শরীফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Sharif University of Technology) থেকে যান্ত্রিক প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দুই বছর পর খাজে নাসিরউদ্দিন তূসী বিশ্ববিদ্যালয় (Khajeh Nasir al-Din Toosi University) থেকে শিল্প প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

মাত্র ২১ বছর বয়সে, ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পরপরই যখন ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) গঠিত হয়, তিনি উত্তর ইরানের তৃতীয় অঞ্চলের গোয়েন্দা বিভাগে একজন তরুণ ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত সূচনা
১৯৮১ সালে সামেনুল-আইম্মাহ (Samen-ol-A’emeh) অভিযানের সফল সমাপ্তির পর—যার মাধ্যমে পশ্চিমা সমর্থিত ইরাকি বাথবাদী বাহিনীর কবল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের আবাদান শহর মুক্ত হয়—তেহরানি মোকাদ্দাম সম্মুখসারির যোদ্ধাদের অগ্নি-সহায়তা ঘাটতি গভীরভাবে অনুভব করেন।

এই উপলব্ধি তাঁকে নতুন এক পরিকল্পনা প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করে, যা তিনি তৎকালীন আইআরজিসি গোয়েন্দা প্রধান শহীদ হাসান বাকেরীর কাছে উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই আইআরজিসির আর্টিলারি কর্পস ও আহওয়াজে আর্টিলারি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

তেহরানি মোকাদ্দাম ১৫৫ মিমি ও ১৩০ মিমি ট্র্যাকশন শেল, এবং পর্তুগিজ ১০৫ মিমি শেল ব্যবহারের মাধ্যমে আইআরজিসির আর্টিলারি ইউনিট গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।

ক্ষেপণাস্ত্র যুগের সূচনা
১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগে, যখন ইরাক পশ্চিমা শক্তিগুলোর (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইরানের শহরগুলোতে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তখন ইরান তার প্রতিরক্ষাগত ঘাটতি পূরণের জন্য সীমিত বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।

তবে তেহরানি মোকাদ্দামের দূরদর্শী নেতৃত্বে আইআরজিসি অর্জিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। তাঁর নেতৃত্বেই ইরানের প্রথম দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয় এবং ১৯৮৫ সালের মার্চে সেটি ইরাকের কিরকুক শহরে সফলভাবে নিক্ষিপ্ত হয়।

দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি বাগদাদের একটি ১৮ তলা সামরিক ভবনে আঘাত হানে, আর তৃতীয়টি বাগদাদের সেনা অফিসার ক্লাব লক্ষ্য করে ছোড়া হয়—যার ফলে প্রায় ২০০ জন বাথবাদী সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন, যারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় জড়িত ছিলেন।

ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের নেতৃত্ব ও প্রতিরোধ ফ্রন্টে সহযোগিতা
১৯৮৬ সালে তেহরানি মোকাদ্দাম আইআরজিসি বিমানবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। একই বছরের শেষ দিকে তিনি লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট গঠনে সহায়তা করেন।

যুদ্ধের শেষ দুই বছরে তিনি “নাজআত” নামের স্বল্পপাল্লার ট্যাকটিক্যাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং “ওকাব” নামের রকেট আর্টিলারি সিস্টেম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন—যা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শিল্পের প্রাথমিক যুগের প্রযুক্তিগত সাফল্যের সূচনা বলে বিবেচিত।

যুদ্ধ-পরবর্তী প্রযুক্তিগত বিপ্লব
যুদ্ধের অবসানের পরও তেহরানি মোকাদ্দাম থেমে থাকেননি। তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শিল্পে ব্যাপক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আনেন—যার ফলে ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা, ধ্বংসক্ষমতা ও নির্ভুলতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এরই ধারাবাহিকতায় “শাহাব” ও “জেলযাল” সিরিজের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়।

১৯৮০-এর দশকে ইরানের হাতে ছিল ৪৫ কিলোমিটার পাল্লার “ওকাব” এবং ১০০ কিলোমিটার পাল্লার “নাজআত” ক্ষেপণাস্ত্র, যা ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তী দশকে “আশুরা” ও “সিজ্জিল”-এর মতো উন্নত মডেল তৈরি হয়।

তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ইরান ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে পরিণত হয়—যার বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার আজ যেকোনো শত্রুকে, বিশেষ করে অবৈধ জায়নিস্ট শাসনকে, প্রতিহত করতে সক্ষম।

শাহাদাত ও চিরন্তন উত্তরাধিকার
২০১১ সালের ১২ নভেম্বর তেহরানি মোকাদ্দাম তেহরানের পশ্চিমে মালার্দ শহরের আমিরুল-মুমিনিন ঘাঁটিতে ১৬ জন সহযোদ্ধাসহ শাহাদাত অর্জন করেন।

তাঁদের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় তেহরানের বেহেশতে যাহরা সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়—যেখানে ১৯৮০-এর দশকের বহু শহীদের কবর রয়েছে।

গত বছর তেহরানে আয়োজিত এক স্মরণসভায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর মহাকাশ বিভাগের তৎকালীন উপ-প্রধান জেনারেল মাজিদ মুসাভি শহীদ তেহরানি মোকাদ্দামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন: “শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের শাহাদাতের পর তাঁর একটি ছবি প্রচারিত হয়েছিল, যার নিচে লেখা ছিল এক গভীর তাৎপর্যময় বাক্য। তখন হয়তো অনেকে তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু আজ সেটি বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন,“ সেই বাক্যে লেখা ছিল—

‘শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম চিরকাল জায়নিস্ট শাসনের জন্য এক দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবেন।’

আজ এই সত্য ইসলামী প্রতিরোধের ভূগোলজুড়ে স্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—সেই পবিত্র ভূমিগুলোতে, যা ইরানের নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের প্রতিরক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করছে।”

তেহরানি মোকাদ্দামের শেষ ইচ্ছা ছিল—

 “আমার কবরফলকে লিখে দিও: এখানে শুয়ে আছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইসরায়েল ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”

শহীদ জেনারেল আমিরআলী হাজিজাদে’র শাহাদাতের (যিনি গত জুনে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনে শহীদ হন) পর বর্তমানে জেনারেল মাজিদ মুসাভি আইআরজিসির মহাকাশ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জেনারেল হাজিজাদে ছিলেন তেহরানি মোকাদ্দামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য ও উত্তরসূরি। তিনি নিজের শাহাদাত পর্যন্ত তাঁর শিক্ষক ও মেন্টরের অসমাপ্ত মিশন অব্যাহত রেখেছিলেন।

তাঁদের যৌথ উত্তরাধিকার সর্বশেষ ১২ দিনের যুদ্ধে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়—যখন শত শত নির্ভুল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র দখলীকৃত ভূখণ্ডে আঘাত হানে এবং বহুস্তরীয় আমেরিকান ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে প্রবল ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়।

আজ ইরানের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশ কর্মসূচি—যা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও সামরিক দক্ষতার বিচারে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়—এই মহান কমান্ডার, শহীদ হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের ত্যাগ, বুদ্ধিমত্তা ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করছে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha