সোমবার ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১১:০২
ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর বিশেষ দৃষ্টি: গায়বাতের যুগের জন্য শিয়াদের প্রস্তুতকরণ

ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার গবেষক ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর সম্মুখীন হওয়া কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি এ অবস্থায় প্রথমত শিয়া সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত রাখার চেষ্টা করেছেন, দ্বিতীয়ত তাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তৃতীয়ত জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন এবং চতুর্থত শিয়াদের ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়বাতের যুগের জন্য প্রস্তুত করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিয়া সমাজের একাদশ ইমাম ইমাম হাসান আসকারি (আ.) হিজরি ২৩২ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র ২৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন লাভ করেন। তবে এই সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি বিশাল ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ভূমিকা রেখে গেছেন। তাঁর জীবদ্দশা ছিল আব্বাসীয় খলিফাদের ক্ষমতা ও কঠোর দমননীতির যুগে, যখন শিয়া ইমামদের সব ধরনের শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

এই কারণেই ইমাম আসকারি (আ.)-কে সামরিক শহর সামারা’র একটি অঞ্চল “আসকার”-এ বাধ্যতামূলকভাবে বসবাস করতে হতো এবং সরকার সর্বক্ষণ তাঁর উপর নজরদারি করত। এই বাধ্যতামূলক আবাসনের কারণেই তিনি “আসকারি” উপাধি লাভ করেন।

ইমামত লাভের পর তিনি এমন এক সময়ে দায়িত্ব নেন যখন শিয়াদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক সীমিত হয়ে গিয়েছিল এবং সরকার তাঁর ইলম, চিন্তাগত ও সামাজিক প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করত। তবুও, ইমাম আসকারি (আ.) একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি ও ওয়াকিল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন, বহু মেধাবী ছাত্র তৈরি করেন এবং ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সাথে আহলে বাইতের (আ.) জ্ঞান ও শিক্ষা শুধু শিয়াদের মধ্যেই নয় বরং সমগ্র মুসলিম সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেন।

তাঁর যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি ছিল শিয়াদেরকে গায়বাতের যুগে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর ইমামত গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা। ইমাম আসকারি (আ.)-এর জীবন ও কর্মকাণ্ড কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং শিয়াদের মানসিক ও সামাজিক পরিচয় গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ইমাম আসকারি (আ.)-এর শাহাদাত উপলক্ষে এবং আব্বাসীয় খলিফাদের কঠোর শাসনের সময় তাঁর জীবন ও শিয়াদের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম হাসান বুস্তামীর সাথে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যার সারমর্ম নিম্নে তুলে ধরা হলো:

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল এবং তিনি কীভাবে আব্বাসীয় খলিফাদের চাপ সত্ত্বেও শিয়াদের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন?

মূলত, ইমাম আসকারি (আ.)-এর ইমামতের সময় কঠোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, যার কয়েকটি দিক হলো:

কঠোর নজরদারি:
ইমাম আসকারি (আ.) সরকার কর্তৃক কঠোর নজরদারির মধ্যে ছিলেন। ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখ আছে যে, তাঁকে “আসকার” নামে একটি সামরিক নগরীতে রাখা হয়েছিল, যা সামারার কাছে অবস্থিত ছিল। তাঁকে প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার শাসকের দরবারে হাজির হতে হতো, যাতে সরকার নিশ্চিত হয় যে তিনি সামারা ছেড়ে মদীনা বা কুফায় যাননি।

মতপার্থক্যের বিস্তার:
শিয়া সমাজে নানা মতাদর্শিক ও বিশ্বাসগত বিভাজন দেখা দিয়েছিল। এমনকি আল্লাহর দেহগত অস্তিত্ব আছে কি না—এসব নিয়েও দীর্ঘ বিতর্ক ও বিভাজন তৈরি হয়েছিল।

ইমামত বিষয়ে সন্দেহ:
শুধু কালাম ও ফিকহ সংক্রান্ত মতবিরোধই নয়, ইমাম আসকারি (আ.)-এর ইমামত নিয়েও কিছু শিয়া সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। শেখ সাদূক (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ইমাম আসকারি (আ.) স্বয়ং বলেছেন যে, “কোনো ইমামের ইমামত নিয়ে আমার মতো এত সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি।” কেউ তাঁর ভাই জাফর ইবনে আলীকে (যিনি পরে “জাফর কাযযাব/মিথ্যাবাদী” নামে পরিচিত হন) ইমাম দাবি করছিল, আবার কেউ ইমাম হাদী (আ.)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণকারী তাঁর জ্ঞানী পুত্র সাইয়্যেদ মুহাম্মদের ইমামতে বিশ্বাসী ছিল। তবে অধিকাংশ শিয়া ইমাম হাদী (আ.)-এর দিকনির্দেশনার মাধ্যমে ইমাম আসকারি (আ.)-এর ইমামতে দৃঢ় ছিল।

রাজনৈতিক বিদ্রোহ: ইসলামের বিভিন্ন অঞ্চলে শিয়াদের নেতৃত্বে অসংখ্য বিদ্রোহ হচ্ছিল। কেউ “নাহি আনিল মুনকার” বা “জালিম সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের” নামে শিয়াদের সমর্থন চাইত। আবার কেউ কেউ “আলাভিয়ুন” নাম ব্যবহার করে কেবল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করত।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) বিভিন্ন চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে শিয়াদের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক বজায় রাখতেন, তেমনি তাদের বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমস্যারও জবাব দিতেন।

এই পরিস্থিতিতে ইমাম আসকারি (আ.) চেষ্টা করতেন প্রথমত— শিয়া সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত রাখা, দ্বিতীয়ত— তাদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, তৃতীয়ত— মানুষের আর্থিক অবস্থার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া, যাতে তারা সরকার বা বিভ্রান্তিকর ভ্রান্ত দলগুলোর দিকে আকৃষ্ট না হয়, এবং চতুর্থত— যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়বাতের যুগের জন্য প্রস্তুত করা।

ইমাম আসকারি (আ.) যিনি বেশিরভাগ সময় সরকারের নজরদারিতে ছিলেন, তিনি কীভাবে শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন?

দুঃখজনকভাবে, সেই সময়কার সরকারের সীমাবদ্ধতার কারণে ইমাম আসকারি (আ.)-এর মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ খুবই সীমিত ও দুর্বল ছিল। তবে ইমাম (আ.) নানা উপায়ে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করতেন। তার কয়েকটি উপায় নিম্নরূপ—
সরাসরি সাক্ষাৎ:
সপ্তাহের কিছু দিন যখন ইমামকে জোরপূর্বক দারুল-খিলাফায় (সরকারি অফিস) যেতে হতো, তখন কিছু শিয়া রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতেন, যাতে তিনি চলাচলের সময় সরাসরি সাক্ষাৎ করা যায় এবং কিছু প্রশ্নোত্তর হয়। পরে সরকার এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরে শিয়াদের হুমকি দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। আলী ইবনে জাফর বর্ণনা করেছেন যে, একদিন যখন ইমামকে দারুল-খিলাফায় নেয়া হচ্ছিল, আমরা ‘আসকার’ অঞ্চলে তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। তখন তাঁর পক্ষ থেকে একটি চিঠি আমাদের কাছে আসে, যেখানে লেখা ছিল: “কেউ যেন আমাকে সালাম না করে, কিংবা হাতে বা মাথার ইশারা না দেয়; কারণ তোমরা নিরাপদ থাকবে না।”

চিঠি প্রেরণ:
ইমাম আসকারি (আ.) নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে প্রভাবশালী শিয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এতে যেমন তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন, তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনা দিতেন। শিয়ারাও নানাবিষয়ে তাঁকে লিখতেন এবং উত্তর পেতেন। ইবনে শাহার আশূব উল্লেখ করেছেন, ইমাম (আ.) কোম শহরের শিয়াদের এবং আওয়া অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষদের উদ্দেশ্যে একাধিক চিঠি লিখেছেন।

দূত প্রেরণ:
ইমাম আসকারি (আ.) নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে পাঠাতেন, যাতে তারা মানুষের বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে এবং ইমামের বাণী পৌঁছে দিতে পারে।

প্রতিনিধি ও উকিল নিয়োগ:
শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় ছিল বিশ্বস্ত প্রতিনিধি বা উকিল নিয়োগ। এরা “উকালাত সংগঠন”-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং পূর্ণ ক্ষমতায় শিয়াদের সমস্যা সমাধান করতেন, এমনকি তারা খুমস ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করে ইমামের কাছে পৌঁছে দিতেন।

কঠিন পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ইমাম (আ.) কেন শিষ্য গড়ে তোলা ও জ্ঞান প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছিলেন?
যেহেতু ইমাম (আ.)-এর সরাসরি উপস্থিতি সীমিত ছিল, তাই তিনি সচেতনভাবে এমন শিষ্যদের তৈরি করতেন যারা শুধু নিজেরাই সঠিক পথ খুঁজে নিত না, বরং অন্যদেরও আহলে বাইতের (আ.) শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত করাত। এসব শিষ্য বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ইমামের দায়িত্ব পূরণ করত। সময়ের সাথে সাথে এদের কিছুজন ইমামের ওকিল হিসেবে নিযুক্ত হন, যারা পরে গায়েবাতের যুগে শিয়া সমাজকে দিকনির্দেশনা দিতেন।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
উসমান ইবনে সাঈদ আমরি: শায়খ তূসী তাকে ইমাম আসকারি (আ.)-এর প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যিনি সকল ধর্মীয় তহবিল সংগ্রহ করে ইমামের কাছে পৌঁছে দিতেন। তিনি পরে গায়েবাত সুগরা যুগে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর প্রথম নায়েবে পরিণত হন।

তাঁর ছেলে মুহাম্মদ ইবনে উসমান-ও পরে উকিল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আহমদ ইবনে ইসহাক আশআরি: কোম শহরে ইমামের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি একাধিকবার ইমামের কাছে খুমস পৌঁছে দিয়েছেন এবং জনগণের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গেছেন।

আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বরকী: বিখ্যাত বই আল-মাহাসিন-এর রচয়িতা। এতে ইমামদের বিভিন্ন বিষয়ে হাদিস সংগ্রহ করা হয়েছে।

আবু হাশিম দাউদ ইবনে কাসিম জাফারি: প্রখ্যাত বংশোদ্ভূত ও ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর প্রাথমিক প্রতিনিধি।

আবু সাহল ইসমাইল ইবনে আলী নৌবাখতি: বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ও লেখক, যিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন।

শায়খ তূসীর মতে, ইমাম আসকারি (আ.)-এর একশোরও বেশি বিশেষ শিষ্য ছিলেন।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha