শনিবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৩:০৬
কারবালার বীরের পেছনের মহীয়সী নারী—উম্মুল বানীন (সা.আ.)

কারবালার রুদ্রময় ইতিহাসে একদিকে যখন বীরত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন হজরত আব্বাস (আ.), ঠিক তখন সেই বীরের অন্তরালে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মহীয়সী নারী—উম্মুল বানীন (সা.আ.)। মাতৃত্বের কোমলতা ও ঈমানের অটলতাকে একই বুকে ধারণ করে তিনি শুধু সন্তান জন্ম দেননি, গড়ে তুলেছিলেন এমন এক ধৈর্যশীল, আনুগত্যপরায়ণ ও ত্যাগী যোদ্ধা, যাঁর নাম শুনলেই কারবালার বীরত্ব ঝলসে ওঠে। তাঁর জীবন আজও প্রমাণ করে—একজন মায়ের বিশ্বাস ও শিক্ষাই জাতিকে উপহার দিতে পারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বীর।

হাওজা নিউজ এজেন্সি'র সঙ্গে এই বিষয়ে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদ  হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মোহাম্মদ তাইয়েব আলী আনসারী; পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি:


হাওজা নিউজ এজেন্সি: আসসালামু ওয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, হাওজা নিউজেকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, উম্মুল বানীন (সা.আ.) কে ছিলেন? তাঁর পরিচয় সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তাইয়েব আলী আনসারী: ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, উম্মুল বানীন (সা.আ.) ছিলেন এমন এক মহীয়সী নারী, যার নাম ইতিহাসে লেখা আছে কারবালার ত্যাগ, ইমান ও আনুগত্যের সুবাসে। তাঁর প্রকৃত নাম ফাতিমা বিনতে হাজাম আল-কালাবিয়া। তিনি ছিলেন বীরত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান একটি আরব গোত্রে জন্মগ্রহণকারী, যার মধ্যে বীরত্ব ছিল বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য।

হজরত আলী (আ.)-এর সঙ্গে বিবাহের পর তিনি শুধু তাঁর পরিবারে স্থানই পাননি—বরং হজরত জাহরা (সা.আ.)-এর সন্তানদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে এক মহৎ উদাহরণে পরিণত করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: উম্মুল বানীন (সা.আ.)-এর চরিত্রের কোন দিক আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তাইয়েব আলী আনসারী: তাঁর নিঃস্বার্থতা এবং হজরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)–এর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা—এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তিনি নিজের পরিচয়কে এমনভাবে আড়াল করে রাখতেন, যেন তাঁর উপস্থিতিতে হজরত জাহরা (সা.আ.)-এর সন্তানদের মনে কোনো কষ্ট না থাকে।

তিনি সবসময় নিজেকে বলতেন: “আমি জাহরার সন্তানদের দাসী।”
মা হয়েও নিজ সন্তানদের চেয়ে তিনি আল্লাহর হুজ্জতদের ভালোবাসা ও মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন—এটাই তাঁর চরিত্রের সর্বোচ্চ মহিমা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হজরত আবুল ফজল আল আব্বাস (আ.)-এর গঠন ও চরিত্র নির্মাণে উম্মুল বানীন (সা.আ.)-এর ভূমিকা কেমন ছিল?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তাইয়েব আলী আনসারী: উম্মুল বানীন (সা.আ.) ছিলেন এমন একজন মা, যিনি তাঁর সন্তানদের বর্ণনা করতেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সেবক ও রক্ষক হিসেবে।

হজরত আব্বাস (আ.)-এর শিশু বয়স থেকেই তিনি তাঁর মনে বসিয়ে দিয়েছিলেন, 
“হুসাইন (আ.) তোমার ইমাম, তাঁর পথে জীবন উৎসর্গ করাই তোমার প্রকৃত কর্তব্য।”

কারবালার ময়দানে যে আনুগত্য, যে বীরত্ব, এবং যে অটল বিশ্বাস হজরত আব্বাস (আ.) দেখিয়েছেন—তার পেছনে রয়েছে মায়ের এই অসাধারণ ত্যাগী শিক্ষাদান।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: কারবালার ট্রাজেডিতে তাঁর ভূমিকা ও অবস্থান আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তাইয়েব আলী আনসারী: কারবালার ঘটনায় তাঁর ত্যাগ অনন্য। চার চারজন সন্তান কারবালায় উৎসর্গ করেছেন, তবুও নিজের সন্তানদের নয়—ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাতের খবরেই তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।

তাঁর বিখ্যাত বাক্য—
“আমার সন্তানের কথা বলো না, হুসাইন (আ.)-এর কথা বলো। তাঁর শাহাদাতই আমার হৃদয় বিদীর্ণ করেছে।”

এমন উচ্চতা খুব কমই ইতিহাসে দেখা যায়। মাতৃত্বের চরম দুঃখকেও তিনি ইমামত ও সত্যের প্রতি আনুগত্যের সামনে তুচ্ছ মনে করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের সমাজে উম্মুল বানীন (সা.আ.) আমাদের জন্য কী শিক্ষা রেখে গেছেন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তাইয়েব আলী আনসারী: তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—

আনুগত্যের মূল্য

পরিবারে নৈতিকতা ও সম্মানের চর্চা

ত্যাগের উৎকর্ষতা

শ্রেষ্ঠত্বের আসল নির্ণায়ক ইমান ও চরিত্র

তিনি দেখিয়েছেন, মা শুধু সন্তান জন্ম দেন না—তিনি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনও করেন। তাঁর লালন-পালনে জন্ম নেওয়া বীর “আব্বাস আলামদার”—তার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

সমাপনী বক্তব্য

উম্মুল বানীন (সা.আ.)-এর জীবন কেবল ইতিহাস নয়—একটি আলোকবর্তিকা, যা পরিবার, সমাজ এবং ইমানদার ব্যক্তির জীবনকে পথ দেখায়। তিনি সেই মহীয়সী নারী, যাঁর দোয়া ও শিক্ষা থেকে কারবালার বীরের জন্ম, এবং যাঁর চোখের অশ্রু আজও মানুষের হৃদয়ে ত্যাগের বার্তা পৌঁছে দেয়।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha