সোমবার ৬ অক্টোবর ২০২৫ - ২০:৩৬
কেন নারীদের সন্তান জন্মদানের আগ্রহ কমে যাচ্ছে?

ইসলামি পরিবার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সাংস্কৃতিক কর্মী মার্জিয়া ফাল্লাহি সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সমসাময়িক সমাজে নারীদের সন্তান জন্মদানে অনীহার কারণ ও এর প্রতিকার নিয়ে এক গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: তিনি বলেন, নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা হ্রাস একটি বহুমাত্রিক ও জটিল সামাজিক বাস্তবতা, যা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক এবং মূল্যবোধের পরিবর্তনের পারস্পরিক প্রভাবের ফলাফল হিসেবে দেখা যায়।

 অর্থনৈতিক চাপ ও জীবিকা অনিশ্চয়তা

মার্জিয়া ফাল্লাহি বলেন, বর্তমান সময়ে বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাকরির অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি এবং সরকারি সহায়তা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। ফলে অনেক পরিবারই ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

তিনি বলেন, সরকারি নীতির প্রতিশ্রুতি ও জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে গভীর ব্যবধান সমাজে অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই অবিশ্বাস মানুষকে সন্তান নেওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছে।
তার মতে, “যখন একটি পরিবার ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হিসেবে উপলব্ধি করে, তখন সন্তান নেওয়াকে তারা একটি আর্থিক ও মানসিক দায় হিসেবে বিবেচনা করে, আশীর্বাদ হিসেবে নয়।”

জীবনধারার পরিবর্তন ও ব্যক্তিগত-পেশাগত অগ্রাধিকারের প্রভাব

তিনি বলেন, আধুনিক সমাজে বিয়ের বয়স বৃদ্ধি, কর্মজীবনের অগ্রাধিকার, প্রজননকাল স্বল্প হওয়া এবং জীবনযাত্রার চাপ নারীদের মাতৃত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্তকে জটিল করে তুলেছে।

বিশেষত উচ্চশিক্ষিত নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির সীমাবদ্ধতা ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা মাতৃত্বকে একপ্রকার “বাধা” হিসেবে উপস্থাপন করছে। অনেক নারী মনে করেন, সন্তান নেওয়া মানে তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রগতির গতি থেমে যাওয়া

ফাল্লাহি বলেন, “আজকের নগরজীবনে মাতৃত্ব অনেক সময় জীবনের গতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হয়। ফলে অনেক নারী এই সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করেন, আবার কেউ কেউ পুরোপুরি তা থেকে বিরত থাকেন।”

মানসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ

মার্জিয়া ফাল্লাহি মনে করেন, সন্তান জন্মের পরের মানসিক চাপ, প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, একাকীত্ব, এবং সামাজিক সহায়তার অভাব নারীদের মাতৃত্ব বিষয়ে ভীতি তৈরি করছে।

তিনি বলেন, বড় শহরগুলোতে পারিবারিক সহায়তা নেটওয়ার্ক—যেমন দাদা-দাদি, নানা-নানির সহায়তা—ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়ায় মা হওয়ার মানসিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফলে মাতৃত্ব অনেক নারীর কাছে আনন্দের পরিবর্তে মানসিক ক্লান্তির প্রতীক হয়ে উঠছে।

এছাড়া পূর্ববর্তী প্রজন্মের কঠিন সন্তান প্রতিপালনের অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং আধুনিক জীবনযাপনের অতিরিক্ত চাপ মিলিয়ে মাতৃত্ব সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মানসিক চিত্র তৈরি হয়েছে।

ধর্মীয় ভিত্তির দুর্বলতা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

তিনি বলেন, “এক সময় সন্তানকে আল্লাহর নিয়ামত ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব হিসেবে দেখা হতো। এখন সেই বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তানহীন জীবনকে স্বাধীনতা’ ও ‘সফলতার’ প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা এক প্রকার নরম সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পারিবারিক জীবনের ইতিবাচক ধারণা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

মার্জিয়া ফাল্লাহির মতে, ইসলামী-ইরানি সমাজে সফল ও মূল্যবোধভিত্তিক পরিবারগুলোর ইতিবাচক উপস্থাপনা গণমাধ্যমে অনুপস্থিত, যার কারণে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ ও পরিবেশগত উদ্বেগ

তিনি আরও বলেন, আধুনিক মানুষ এখন শুধুমাত্র আর্থিক নয়, পরিবেশগত ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন। পানি সংকট, বায়ুদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা—এসব বিষয় অনেক নারীর মনে সন্তান জন্মদানের বিরুদ্ধে যৌক্তিক উদ্বেগ তৈরি করছে।

তাদের কাছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এখন পরিবেশ, জীবনমান ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের প্রতি এক ধরনের হতাশা তৈরি করছে, যা প্রজনন হার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সমাধানের পথ

মার্জিয়া ফাল্লাহি বলেন, ইসলামি-ইরানি সংস্কৃতির দৃষ্টিতে সন্তান জন্মদান কেবল একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব ও আধ্যাত্মিক মিশন—যার উদ্দেশ্য নেক প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা, পারিবারিক স্থিতিশীলতা এবং সমাজের নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করা।

তিনি মনে করেন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, পারিবারিক সহায়তা ব্যবস্থা ও বুদ্ধিদীপ্ত নীতি প্রণয়ন—এই তিনের সমন্বয়ে সমাজে পুনরায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করা সম্ভব।

আশাবাদী সাংস্কৃতিক গঠন পুনর্নির্মাণ

তিনি বলেন, “সন্তান জন্মদানের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক আস্থার মধ্যে একটি সমন্বিত দৃষ্টি প্রয়োজন।”

গণমাধ্যম, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এমন বাস্তব ও অনুপ্রেরণামূলক পারিবারিক গল্প তুলে ধরতে হবে—যেখানে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও আধুনিক জীবনের চাহিদা একসঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।

তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের উচিত এমন পরিবারের চিত্র তুলে ধরা যারা ভালোবাসা, পারিবারিক ঐক্য ও ব্যক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে আধুনিক সমাজে মূল্যবোধভিত্তিক জীবনযাপন বজায় রেখেছে। এসব ইতিবাচক গল্প সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকর সাংস্কৃতিক বার্তাকে দুর্বল করবে।”

জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ

মার্জিয়া ফাল্লাহি প্রস্তাব করেন, পরিবার ও সন্তান জন্মদানে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

এর অংশ হিসেবে তিনি সুপারিশ করেন—

  • পরিবারকেন্দ্রিক জাতীয় উৎসব ও প্রচারণা আয়োজন,
  • অনুপ্রেরণামূলক শিল্পকর্ম ও নাট্যরচনা তৈরি,
  • সফল পারিবারিক মডেলের প্রচার,
  • এবং মসজিদ, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবারভিত্তিক আলোচনা ও পরামর্শ কার্যক্রম পরিচালনা।

তার মতে, “পরিবার শুধু সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট নয়, বরং এটি জাতির নৈতিক ও মানসিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারে যদি ভালোবাসা, আস্থা ও নৈতিক শক্তি থাকে, তবে সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও টিকে থাকবে।”

শেষে মার্জিয়া ফাল্লাহি বলেন, “সন্তান জন্মদানকে যদি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইচ্ছা নয়, বরং সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব হিসেবে পুনরায় উপলব্ধি করা যায়, তবে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারব যেখানে পরিবার হবে উন্নয়ন, ভালোবাসা ও মানবিকতার কেন্দ্র।”

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক আস্থা, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার সমন্বয় ঘটলে নারীদের মাতৃত্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে ইতিবাচক পথে ফিরে আসবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha