সোমবার ২৭ অক্টোবর ২০২৫ - ১৫:০৯
হযরত জয়নাব (সা.) কীভাবে পরিপূর্ণ মানবতার প্রতীক হয়ে উঠলেন?

কুরআন পুরুষ ও নারীকে মানবতার দিক থেকে সমান মর্যাদা দিয়েছে। হযরত জয়নাব (সা.) তাঁর ঐশী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টির মাধ্যমে সব বিপর্যয়ের মাঝেও আল্লাহর সৌন্দর্য দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন: «ما رأیتُ إلّا جمیلاً» — “আমি তো শুধু সৌন্দর্যই দেখেছি।”

হাওজা নিউজ এজেন্সি / হযরত জয়নাবে কুবরা (সা.) মানবতার এক পরিপূর্ণ নমুনা। কুরআন পুরুষ ও নারীকে মানবতার দিক থেকে সমান মর্যাদা দিয়েছে। হযরত জয়নাব (সা.) তাঁর ঐশী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টির মাধ্যমে সব বিপর্যয়ের মাঝেও আল্লাহর সৌন্দর্য দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন: «ما رأیتُ إلّا جمیلاً» — “আমি তো শুধু সৌন্দর্যই দেখেছি।”
তিনি শহীদ হওয়া ও বন্দিত্বের সত্য অর্থকে আল্লাহ-প্রদত্ত জ্ঞানের আলোকে উপলব্ধি করেছিলেন। আর পর্দা বা হিজাবও নারীর সৌন্দর্য, মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

জয়নাবে কুবরা (সা.)-মানবতার সম্পূর্ণ রূপ

আয়াতুল্লাহ আল-উজমা জাওয়াদী আমুলি কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের বার্ষিক ২০তম সম্মেলনে প্রেরিত বার্তায় বলা হয়েছে:
হযরত জয়নাবে কুবরা (সা.) মানবতার এক নিখুঁত উদাহরণ।
প্রথমেই বলা দরকার যে, নারী ও পুরুষের আসল সত্তা প্রায় সমান, কারণ আত্মা বা রূহ না পুরুষ, না নারী। ইসলামী দার্শনিকদের মধ্যে ইবনে সিনা স্পষ্টভাবে বলেছেন-রূহের কোনো লিঙ্গ নেই।

পুরুষ ও নারী হওয়া কেবল দেহের বৈশিষ্ট্য; দেহ এমনভাবে সৃষ্টি হয়েছে বা অন্যভাবে, কিন্তু আত্মা যেহেতু বস্তুজগতের বাইরে এক অদৃশ্য সত্তা, তাই সে দেহগত বৈশিষ্ট্য ও অংশবিশেষ থেকে মুক্ত।
তবে দেহ আলাদা হওয়ার কারণে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যে নারী-পুরুষের মধ্যে আংশিক পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মূল বিশ্বাস, জ্ঞান ও আইনগত দিক থেকে নারী-পুরুষ উভয়েই সমান অংশীদার। কেবল দেহসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে তারা পৃথক।

অতএব, নারী ও পুরুষের প্রকৃত সত্তা-যা আত্মা-তাতে কোনো পার্থক্য নেই।
কুরআনও নারী ও পুরুষ উভয়কেই মানবতার উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং একে অপরের প্রতি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে।

যখন কুরআন “সৎ মানুষের উদাহরণ” দিতে চায় (শুধু “সৎ পুরুষদের” নয়), তখন মরিয়ম (আ.) ও ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া-এর নাম উল্লেখ করে।
আয়াতে বলা হয়েছে:

«ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلاً لِلَّذینَ آمَنُوا امْرَأَتَ فِرْعَوْنَ» — “আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য ফিরআউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।”

অর্থাৎ, “সৎ মানুষের” উদাহরণ নারীও হতে পারেন, যেমন “অসৎ মানুষের” উদাহরণও নারী হতে পারে।

এ থেকে বোঝা যায়, কুরআন নারী ও পুরুষ উভয়কেই মানবতার সমান মানদণ্ডে স্থান দিয়েছে। যদিও কিছু শারীরিক কারণে তাদের কিছু বিধানে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু আধ্যাত্মিক সত্যে তারা সমান মর্যাদার অধিকারী।

জয়নাব (সা.)-ঐশী জ্ঞানের ধারক

যদি বনি হাশিমের বুদ্ধিজীবী নারী জয়নাবে কুবরা (সা.) ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর বিশেষ সম্মান পান, তবে এর কারণ এই যে, তিনি “মানবতার সত্য” অনুধাবন করেছিলেন এবং সেই জ্ঞান অনুসারে জীবনযাপন করেছিলেন।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তাঁকে বলেছিলেন:

«أَنْتِ بِحَمْدِ اللَّهِ عَالِمَةٌ غَیْرُ مُعَلَّمَةٍ، فَهِمَةٌ غَیْرُ مُفَهَّمَة»
“তুমি এমন এক জ্ঞানী, যিনি মানবিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা না নিয়েও জ্ঞান অর্জন করেছো, আর এমন বুদ্ধিমতী, যিনি কারও শেখানো ছাড়াই বোঝার ক্ষমতা পেয়েছো।”

এই কারণেই তিনি এমন গভীর কথা বলেছিলেন, যা খুব কম মানুষ বলতে পারে বা বুঝতে পারে।

মৃত্যু, শহীদত্ব ও আধ্যাত্মিক দর্শন

কুরআনে বলা হয়েছে—মানুষ মৃত্যুর সময় দুই রকমের হয়:
একদল পবিত্র, অন্যদল অধার্মিক।

«الَّذینَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلائِکَةُ طَیِّبینَ» — “যাদের ফেরেশতারা মৃত্যুকালে পবিত্র অবস্থায় কবজ করে।”
এই মানুষরা জীবদ্দশায়ও নির্মল ছিলেন, মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা তাদের অভ্যর্থনা করে বলে: “আল্লাহর সালাম তোমাদের উপর বর্ষিত হোক।”

আর যারা অধার্মিক, তাদের প্রতি ফেরেশতারা কঠোর হয়,

«یَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَ أَدْبَارَهُمْ» — “তাদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করা হয়।”
এটাই মৃত্যুর যন্ত্রণার প্রতীক।

মানুষের মৃত্যুকালে তার অন্তর্নিহিত সত্তা প্রকাশ পায়—সৎ হলে সৌন্দর্য, অসৎ হলে কুরূপতা।
এই সত্য পুরুষ ও নারী উভয় ঐশী মানুষ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।

“আমি তো শুধু সৌন্দর্যই দেখেছি”

যখন কুফার প্রাসাদে ইবনে জিয়াদ জিজ্ঞেস করেছিল:

“তোমার ভাই ও পরিবার নিয়ে আল্লাহ কী করেছেন, তুমি কেমন দেখেছো?”

হযরত জয়নাব (সা.) উত্তর দিয়েছিলেন:

«ما رأیتُ إلّا جمیلاً» — “আমি তো শুধু সৌন্দর্যই দেখেছি।”

কারণ তিনি শহীদত্বের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য দেখেছিলেন-শহীদ কখনও মরে না, বরং চিরজীবী থাকে।
এইভাবেই তিনি বিপর্যয়ের মাঝেও আল্লাহর মহিমা ও সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

তাঁর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি বন্দিত্বের মধ্যেও আল্লাহর গরিমা উপলব্ধি করেছিল।
তাই তিনি বলেছিলেন,

“ما رأیتُ إلّا جمیلاً” — “আমরা এই সফরে শুধু সৌন্দর্যই দেখেছি।”

এই উপলব্ধিই বিশ্বকে জাগিয়ে তোলে।

পর্দা-নারীর গৌরবের প্রতীক

হিজাব বা পর্দা নারীজাতির অলংকার, মর্যাদা ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
যাতে নারীর সম্মান ও গরিমা অক্ষুণ্ণ থাকে, তাই আল্লাহ তাআলা পর্দার বিধান দিয়েছেন।
এটি নারীর ব্যক্তিত্বকে রক্ষা করে এবং তাকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

উৎস:
আয়াতুল্লাহ আল-উজমা জাওয়াদী আমোলি-র বার্তা,
২০তম বার্ষিক মুসলিম কংগ্রেস, যুক্তরাষ্ট্র,
তারিখ: ১৯ আাবান (ইরানি ক্যালেন্ডার)

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha