হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত যাহরা (সা.আ.)–এর সন্তানদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিনয় ছিল তাঁর গভীর ধর্মীয় জ্ঞান, বেলায়েত–বোঝাপড়া এবং আহলে বাইত (আ.)–এর মর্যাদা সম্পর্কে উচ্চাঙ্গ উপলব্ধির উজ্জ্বল পরিচয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁকে শিয়াদের ঐতিহাসিক স্মৃতিতে বসিরাত, শৌর্য, বেলায়েত–নিষ্ঠা এবং আদর্শিক লালন–পালনের প্রতীক করে তুলেছে। এবং এ সকল গুণই তাঁর সন্তান হযরত আবুল ফজল (আ.)–এর চরিত্র নির্মাণে এক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর মাকাম ও মর্যাদা
হযরত ফাতিমা বিনতে হিজাম—যিনি উম্মুল বানীন (সা.আ.) নামে সুবিখ্যাত—ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং ব্যতিক্রমী নারীদের একজন। তাঁর নাম জড়িয়ে আছে বফাদারি, শিষ্টাচার, মারেফাতে বেলায়েত, ইখলাস ও ত্যাগ–তিতিক্ষার সঙ্গে।
তাঁর পরিবার—বানু কিলাব—আরবের সবচেয়ে সম্মানিত ও বীরত্বশালী গোত্রের একটি ছিল; ফলে ধীরতা, সম্মান, বীরত্ব ও উচ্চ নৈতিকতার গুণাবলি তাঁর চরিত্রে প্রাকৃতিকভাবেই বিদ্যমান ছিল।
হযরত যাহরা (সা.আ.)–এর শাহাদাতের পর আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। উম্মুল বানীন (সা.আ.) বিয়ের শুরু থেকেই নিজেকে এ ঘরের “পরিচারিকা” হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)–এর প্রতি এমন সম্মান, ভালোবাসা ও বিনয় দেখাতেন যা ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদায় উল্লেখিত। এমনকি তিনি বলতেন, “আমাকে ফাতিমা বলে ডাকবেন না; এতে তাঁদের মায়ের স্মৃতি জেগে উঠবে, আর তাদের হৃদয় ব্যথিত হবে।”
সন্তান–লালন ও বেলায়েত চেতনা
এই দাম্পত্যের ফলস্বরূপ জন্ম নেন চার মহিমান্বিত সন্তান— হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ, জাফর ও উসমান। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে হযরত আবুল ফজল (আ.)–এর চরিত্র ও নৈতিক গঠন স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর আত্মিক ও শিক্ষাগত স্থান কত উচ্চে ছিল। তিনি সন্তানদের শৈশব থেকেই ইমাম হুসাইন (আ.)–এর প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য, বেলায়েত–নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গের চেতনায় গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বারবার বলতেন, “আমার সন্তানরা—ফাতিমা (সা.আ.)–এর সন্তানদের জন্য ফেদায়ী (উৎসর্গিত)।”
তাঁর উচ্চতম মাকাম সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পায় কারবালার ঘটনায়। উম্মুল বানীন (সা.আ.) কোনো আবেগ বা অজ্ঞতার বশে নয়, বরং পূর্ণ মারেফাত, বাসিরাত (অন্তর্দৃষ্টি) ও সচেতনতার ভিত্তিতে তাঁর সন্তানদের ইমাম হুসাইন (আ.)–এর সাথে পাঠিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বেলায়েতের সত্য ও ইমামতের হক্ক সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন।
আশুরার পর যখন তাঁর সন্তানদের শাহাদাতের সংবাদ আসে, তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, “হুসাইনের কী হলো? আমাকে হুসাইনের খবর বলো; আমার সন্তানরা হুসাইনের জন্যই উৎসর্গিত।” এই একটি বাক্যই তাঁর ঈমান, ধৈর্য, চরিত্র–মহত্ত্ব ও বেলায়েত–মারেরফাতকে স্পষ্ট করে দেয়।
আশুরার পর ভূমিকা
কারবালার পর মাদীনায় ফিরে উম্মুল বানীন (সা.আ.) শোক–পীড়িতদের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজের হৃদয়বিদারক মারসিয়া, বিলাপ ও বর্ণনার মাধ্যমে কারবালার সত্য ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। লোকেরা তাঁর বাড়ির সামনে জড়ো হত, আর তিনি তাঁদের সামনে কারবালার স্মৃতি, জুলুম ও শাহাদাতের ঘটনাগুলো তুলে ধরতেন।
এই কারণে আলেমগণ তাঁকে বলেছেন— “আরিফায়ে কারবালা” (কারবালার সত্য–বর্ণনাকারী) এবং “ওফাদারির (আনুগত্যের) প্রতীক”।
উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর ব্যক্তিত্ব চারটি প্রধান গুণে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল—
১. ইমামতের গভীর মারেফাত ও বেলায়েত–চেতনা
২. আহলে বাইত (আ.)–এর ঘরে অসাধারণ আদব, বিনয় ও বিশ্বস্ততা
৩. ত্যাগী, শৌর্যবান ও ইমামত–নিষ্ঠ সন্তানদের গড়ে তোলা
৪. অতুলনীয় ধৈর্য, দৃঢ়তা এবং আশুরার বার্তা জীবিত রাখা
সন্তান–লালনের নীতিমালা
হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর বিশেষত্ব শুধু এই নয় যে তিনি আবুল ফজল (আ.) ও তাঁর তিন ভাইয়ের মা ছিলেন; বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো—তিনি কী ধরনের মানুষ গড়েছিলেন। তাঁর সন্তান–লালন পদ্ধতির মূল ভিত্তি ছিল—
১. বেলায়েতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যমূলক চরিত্রগঠন
তিনি সন্তানদের নিজের সন্তান হিসেবে নয়; বরং আলীর সন্তান, হুসাইনের সৈনিক এবং ইমামের খাদক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, “আমার সন্তানরা ফাতিমা (সা.আ.)–এর সন্তানদের জন্য উৎসর্গিত।”
২. সাহস ও আদবের সংমিশ্রণ
হযরত আব্বাস (আ.)–এর সাহস ছিল কিংবদন্তির মতো; কিন্তু তা কোনো বেপরোয়া সাহস ছিল না। এটি ছিল—সাহস + আদব + বেলায়েত–বোধ।
৩. মমতা–পূর্ণ কিন্তু কর্তব্য–কেন্দ্রিক মাতৃত্ব
উম্মুল বানীন (সা.আ.) ছিলেন স্নেহময়ী মা; কিন্তু তাঁর মমতা কখনো সন্তানদের কর্তব্য থেকে বিরত রাখেনি। কারবালার সংবাদ আসার পর তিনি প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলেন— “আব্বাসের নয়—হুসাইনের খবর বলো।”
৪. “সাইয়্যিদ (উচ্চবংশীয়)-সন্তান” নয়; “ইমামের খাদেম” হিসেবে পরিচয়
তিনি কখনো চাননি সন্তানরা বংশগৌরব বা বংশমর্যাদায় গর্ব করুক। তাঁর আদেশ ছিল— “তোমাদের পরিচয় হবে সেবা, তোমাদের গৌরব হবে বেলায়েত।”
হযরত আবুল ফজল (আ.) ছিলেন তাঁর এই শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট ফল।
বেলায়েত–মারেফাতের উৎস
হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর বেলায়েত–জ্ঞান কোনো আবেগনির্ভর বা আকস্মিক বিষয় ছিল না। এর উৎস ছিল—
১. বংশগত নৈতিকতা – বনী কিলাবের শুদ্ধ চরিত্র, বীরত্ব, আনুগত্য এবং নৈতিকতার ঐতিহ্য
২. ইমাম আলী (আ.)–এর সুদূরদৃষ্টিময় নির্বাচন – চরিত্র, বেলায়েত গ্রহণের ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী বিবাহ
৩. আচরণ ও আদব – ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)–এর প্রতি মর্যাদাশীল আচরণ
৪. আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা ও বসিরাত – জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির ভিত্তিতে বেলায়েত–চেতনা
কারবালা ও আশুরার পর সামাজিক ভূমিকা
কারবালার আগে ও পরে উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর কর্মকাণ্ড প্রকাশ করে—
১. সন্তানদের সম্পূর্ণ বেলায়েত–নিষ্ঠা চেতনায় গড়ে তোলা
২. কারবালার সত্য ইতিহাস ও জুলুমের বর্ণনা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া
৩. শোকাহতদের আশ্রয় ও সহমর্মিতা প্রদর্শন
৪. সমাজে বেলায়েত–চেতনাকে জীবন্ত রাখা
শিয়া ঐতিহ্যে তিনি পরিচিত—
• “কারবালার আরিফা”
• “বেলায়েত–নিষ্ঠার আদর্শ নারী”
হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর জীবন নির্দেশ করে—
১. বংশমর্যাদা নয়, ইমাম ও বেলায়েতের সেবাই প্রকৃত মর্যাদার ভিত্তি।
২. সন্তানরা কখনো উচ্চবংশীয় হিসেবে পরিচিত হোক—এটা তাঁর লক্ষ্য ছিল না।
৩. হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আ.)–এর জীবন ও চরিত্রের মাধ্যমে এই শিক্ষা সর্বোচ্চভাবে প্রকাশ পায়।
তাঁর জীবন আধুনিক সমাজে নৈতিকতা, নেতৃত্ব, বেলায়েত–চেতনা এবং আদর্শিক পারিবারিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় চিরন্তন দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
আপনার কমেন্ট