হাওজা নিউজ এজেন্সি: “আল্লাহ আমাকে কেন সৃষ্টি করেছেন?”—এই প্রশ্ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন আমরা উপলব্ধি করি যে সৃষ্টিই এক অমূল্য উপহার—যার প্রকৃত মূল্য আমরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারিনি।
কখনও কেউ হতাশা নিয়ে বলে, “আমি তো সৃষ্টি হতে চাইনি! কেন আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করলেন? কি এজন্য যে আমি পাপ করব এবং শেষে জাহান্নামে যাব?” কিন্তু একটু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়—এই প্রশ্নের মূল ভিত্তিই ভুল।
আমি সৃষ্টির আগে ‘ছিলামই না’—যে চাইব বা চাইব না!
যে ব্যক্তি বলে “আমি সৃষ্টি হতে চাইনি”—সে বুঝতে পারে না যে “আমি” নামক সত্তা সৃষ্টির আগে আদৌ ছিল না। যে অস্তিত্বই ছিল না, তার তো ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রসঙ্গও নেই।সুতরাং ভ্রান্ত ভিত্তিতে দাঁড়ানো প্রশ্ন কখনই সঠিক উত্তরে পৌঁছায় না।
সঠিক প্রশ্ন হলো—“এখন যেহেতু আমি আছি, আমি কি সত্যিই থাকতে চাই?”
কোনো বিবেকবান মানুষ যদি এক মুহূর্ত শান্তভাবে ভাবেন, বুঝবেন—মানুষ স্বভাবতই ‘অস্তিত্ব’কে ভালোবাসে। আমরা জীবন, সৌন্দর্য, জ্ঞান, শক্তি, আনন্দ, ভালোবাসা সবকিছুকেই ভালোবাসি। এই ভালোবাসা আমাদের মধ্যে জন্মগতভাবে স্থাপিত।
অস্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা—অস্তিত্বদাতার প্রতিই আকর্ষণ
মানুষ কেন সৌন্দর্য ভালোবাসে? কেন কামের দিকে ধাবিত হয়? মাধ্যমে ভুল হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার মূল আকর্ষণটা সবার মধ্যেই একই। কারণ এ প্রেম আল্লাহর প্রেমেরই প্রতিফলন। মানুষ আল্লাহর নামসমূহের প্রতিচ্ছবি। এ কারণেই সে স্বভাবতই তার উৎসের প্রতি আকৃষ্ট।
আল্লাহ বলেন, “আমি শুকনো কাদার মতো মাটি থেকে এক মানুষ সৃষ্টি করব।যখন তাকে পরিপূর্ণ করব এবং তাতে আমার রূহ প্রবেশ করাব—তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেয়ো।” (হিজর: ২৮–২৯) অর্থাৎ মানুষ মাটি—কিন্তু তাতে আল্লাহ তাঁর রূহের অংশ দিয়েছেন। এটাই মানুষের অন্তর্গত মর্যাদা।
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদ আমুলী সুন্দরভাবে বলেন,
“দুটি শতাব্দী আগে মানুষ ছিল মাটি; দুটি শতাব্দী পরে সে আবার মাটিতে ফিরে যাবে। কিন্তু একটি ঈশ্বরীয় সত্য তার ভেতরে রয়ে যায়—যা কখনো মরে না। সেই রূহই মানুষকে আল্লাহর খলিফা বানিয়েছে।”
আল্লাহ মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেননি
এই ধারণা শয়তানের কুমন্ত্রণা। সে নিজে হতাশ হয়েছে এবং চায় তুমিও তার মতোই আশা হারাও। কিন্তু আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—সৃষ্টির উদ্দেশ্য শাস্তি নয়; বরং মর্যাদা, কামের দিকে যাত্রা।
আল্লাহ বলেন, “তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীর খলিফা করেছেন।” (ফাতির: ৩৯) অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি—মূল্য, সম্মান ও দায়িত্বের জন্য; ধ্বংসের জন্য নয়।
গুনাহ পথের শেষ নয়—বরং ফিরে আসার সূচনা
কুরআন গুনাহকে জাহান্নামের নিশ্চয়তা বলে না; বরং গুনাহে স্থির থাকা এবং ফিরে না আসাই মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন, “যারা কোনো অশ্লীলতা করে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করে—তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তওবা করে।” (আল ইমরান: ১৩৫) অর্থাৎ উত্তমরা তারা, যারা ভুল করলেও হতাশ না হয়ে তৎক্ষণাত ফিরে আসে।
আর সেই দয়া-ভরা আয়াত— “বলুন, হে আমার সেই বান্দারা যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছ—আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না…” (আয্-যুমার: ৫৩) অর্থাৎ তুমি যত পাপী হও—আল্লাহ কখনোই তোমাকে হতাশ দেখতে চান না।
জাহান্নামের পথ মানুষ নিজেই বেছে নেয়—এটা আল্লাহর পরিকল্পনা নয়
যদি কেউ বলে, “হে আল্লাহ! আমি ভালো হতে চাই না, তোমার নেয়ামত গ্রহণ করতে চাই না, তওবা করতেও চাই না—তাহলে তুমি কেন আমাকে সৃষ্টি করলে যে জাহান্নামে যাই?” এ কথা অভিযোগ নয়; এটি নিজের বেছে নেওয়া ভুল পথের প্রতিবাদ মাত্র।
আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন না। পথ খুলে দিয়েছেন, আর দিয়েছেন ক্ষমার অসংখ্য সুযোগ।
আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো—তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন।” (আল ইমরান: ৩১)
কিন্তু—“যারা আল্লাহর আয়াত ও তাঁর সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেছে—তারা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে গেছে।” (আনকাবুত: ২৩) অর্থাৎ যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহকে উপেক্ষা করে—তারাই নিজেদের জন্য হতাশার পথ খুলে দেয়।
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন— অস্তিত্ব, বিকাশ, সৌন্দর্য, কামের, এবং জান্নাতের জন্য। জাহান্নাম মানুষের আসল গন্তব্য নয়; বরং তা তাদের পরিণাম, যারা নিজেদের হাতে আল্লাহর দয়ার সব দরজা বন্ধ করে দেয়।
শয়তান বলে, “তুমি অবশ্যই জাহান্নামী।” কিন্তু আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।”
মূল প্রশ্নটাই তাই ভ্রান্ত।আল্লাহ নৈরাশ্যের নয়—মূল্য, আশা এবং রহমতের স্রষ্টা। আর আমরা এসেছি আল্লাহর খলিফা হওয়ার পথে এগোতে—জাহান্নামের জন্য নয়।
আপনার কমেন্ট