হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্বের উপস্থাপিত ফেমিনিস্ট স্লোগান বর্তমানে নারীদের স্বাধীনতার নামে এক নতুন মানসিক দাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উপরিভাগে এই আন্দোলন নারীর অধিকারের পতাকাবাহী মনে হলেও বাস্তবে এটি নারীদের তাদের স্বাভাবিক পরিচয়, আত্মমর্যাদা এবং আত্মিক অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বিপরীতে ইসলাম হজরত যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনধারার মাধ্যমে নারীর জন্য এমন পূর্ণাঙ্গ, মর্যাদাপূর্ণ ও বাস্তব মডেল দিয়েছে যা শুধু স্লোগান নয় বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে অনুসরণযোগ্য পথনির্দেশ।
ঠিক এই গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করে মুম্বাইয়ের মসজিদে ইরানিয়ান (মুঘল মসজিদ)-এর ইমাম, বিশিষ্ট গবেষক ও হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জেদী হাওজা নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া তাঁর বিশেষ সাক্ষাৎকারে ফেমিনিজমের বৌদ্ধিক পটভূমি, তার দাবির বাস্তবতা এবং শাহীযাদী ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনধারার তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে ইসলাম নারীকে শুধু অধিকার নয়, বরং ব্যক্তিত্ব, নিরাপত্তা এবং পবিত্রতার একটি পূর্ণাঙ্গ পথ দেখিয়েছে।
সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার নিম্নরূপ:
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
আজ বিশ্বের সর্বত্র নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ফেমিনিজম নামে বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। আপনি সামগ্রিকভাবে ফেমিনিজমকে কীভাবে দেখেন?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
আমরা যে যুগে বসবাস করছি, তা বাহ্যিকভাবে উন্নতির যুগ হলেও ধারণাগতভাবে এটি ফাঁপা স্লোগান ও প্রতারণামূলক চিন্তার যুগ।
আজ শিল্প-প্রযুক্তির পাশাপাশি ভুয়া পণ্য, ভুয়া কোম্পানি এবং ভুয়া মতাদর্শও ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভুয়া স্লোগানগুলোর একটি হলো “নারীর অধিকার”—যা কিছু মহল ফেমিনিজম নামে উপস্থাপন করেছে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, এই স্লোগানের বাহকরা অনেকক্ষেত্রে নিজেরাই নারীদের শোষণ করেন। ফেমিনিজমের দাবি যতই শক্তিশালী হোক, বাস্তবে এটি নারীদের সেই মর্যাদায় পৌঁছে দিতে পারেনি যা ইসলাম দিয়েছে।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
ফেমিনিজম শব্দটি নিয়ে সাধারণভাবে বিভ্রান্তি আছে। আপনি এই শব্দটি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
“ফেমিনিজম” শব্দটি ফরাসি ও লাতিন উৎস থেকে এসেছে, এর আক্ষরিক অর্থ নারীর অবস্থান ও অধিকারকে তুলে ধরা।
এটি দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়—
১. প্রথম অর্থ:
একটি মতাদর্শ ও আন্দোলন, যা নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতা দাবি করে। কিছু স্থানে এটি নারীর আধিপত্যবাদে পরিণত হয়।
২. দ্বিতীয় অর্থ:
পুরুষদের মাঝে নারীর মতো বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ—যা এখানে আলোচ্য নয়।
সামগ্রিকভাবে ফেমিনিজম ১৯শ শতাব্দীতে উন্নত বিশ্বে শুরু হয়। পরে এর নানা প্রবণতা ও চরমপন্থী শাখা জন্ম নেয়। মূল দাবি ছিল নারীর অধিকার—যদিও কখনোই বাস্তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
এর বিপরীতে ইসলাম নারীর মর্যাদাকে স্লোগানে নয়, বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যার উজ্জ্বল উদাহরণ হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর পবিত্র জীবন।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
আপনার দৃষ্টিতে হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) কীভাবে নারীর জন্য আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
সাইয়্যেদাতুন নিসা–এর জীবনে আমরা এমন সব দৃষ্টান্ত দেখি—নারীর অধিকার, মর্যাদা, দায়িত্ব ও সামাজিক ভূমিকা—যা পৃথিবীর অন্য কোনো আন্দোলনে নেই।
আপনি যেভাবে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও শিক্ষা—প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন, তা নারীর প্রকৃত মর্যাদার সর্বোচ্চ ব্যাখ্যা।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
পরিবার ও দাম্পত্য জীবনে তাঁহার ভূমিকা নারীর স্থানকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলে?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
বিবি (সা.আ.)-এর ঘরোয়া জীবন ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও দায়িত্বপূর্ণ আচরণের এক অনন্য উদাহরণ।
ইসলাম নারীর উপর অনেক গৃহস্থালি কাজ বাধ্যতামূলক করেনি—তবুও আপনি (সা.আ.) আন্তরিকভাবে সব কাজ করেছেন, যাতে বোঝা যায়—পরিবারের দৃঢ়তায় নারীর ভূমিকা মূল ভিত্তি।
হাতে ফোলা পর্যন্ত ঘরের কাজ করতেন। স্বামীর সন্তুষ্টির প্রতি এত যত্নশীল ছিলেন যে সামান্য সন্দেহ হলেও ক্ষমা চাইতেন। মৃত্যুশয্যাতেও বলেছিলেন—
“এ ঘর আপনার ঘর, আমি আপনার স্ত্রী—আপনার ভালো লাগা মতো সিদ্ধান্ত নিন।”
যদি আমাদের ঘরগুলোতে ফাতিমীয় আচরণ ও পারস্পরিক সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়, অনেক পারিবারিক সমস্যা নিজে থেকেই মুছে যাবে।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
জ্ঞান ও বৌদ্ধিক দিক থেকে হজরত যাহরা (সা.আ.)-এর অবস্থান কী?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
সাইয়্যেদা (সা.আ.) ছিলেন জ্ঞান ও তাকওয়ার পূর্ণ প্রতিচ্ছবি।
মদিনার নারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়ে তাঁর কাছে আসতেন এবং তিনি ধৈর্য ও কোমলতায় উত্তর দিতেন।
একজন নারী বহুবার প্রশ্ন করে লজ্জা প্রকাশ করলে আপনি (সা.আ.) বলেছিলেন—
“যতবার ইচ্ছা জিজ্ঞেস করো; তোমার প্রশ্নে আমি বিরক্ত হই না।”
এটি নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় চেতনার সর্বোচ্চ উদাহরণ।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তিনি নারীর জন্য কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
বিবি (সা.আ.) প্রমাণ করেছেন—নারী সত্য ও ন্যায়ের জন্য আওয়াজ তুলতে পারে, তোলা উচিত—যে পরিস্থিতিই আসুক।
খিলাফতের বিষয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নেন।
তাঁর খুতবায়ে ফাদাক নারীর রাজনৈতিক সচেতনতার সর্বোচ্চ নিদর্শন।
ইসলাম নারীকে নিস্তব্ধ বা দুর্বল নয়—সচেতন, সক্রিয় এবং সত্যবাদী হিসেবে দেখতে চায়।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
ফেমিনিজম ও সাইয়্যেদাতুন নিসা (সা.আ.)-এর জীবনধারার মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
ফেমিনিজমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—এতে দাবি বেশি, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ খুবই কম।
ইসলাম নারীর জন্য সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়েছে—এবং হজরত যাহরা (সা.আ.) সেই ব্যবস্থার জীবন্ত উদাহরণ।
ফেমিনিজম পরিবার ও সমাজের কাঠামো ভেঙে দেয়; ফাতিমীয় জীবন তা গুছিয়ে দেয়, সংহত করে ও শক্তিশালী করে।
ইসলাম নারীকে ঘর, সমাজ, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রে সম্মানজনক ভূমিকা দেয়, কিন্তু তার স্বাভাবিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখে।
হাওজা নিউজ এজেন্সি:
আজকের নারীদের জন্য আপনার বার্তা কী?
হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ নাজিবুল হাসান জাইদী:
আমাদের উচিত ফেমিনিজমের ফাঁপা স্লোগান ও পশ্চিমা ধারণার বদলে সাইয়্যেদাতুন নিসা–এর জীবনকে কেন্দ্র করা।
একজন নারী যদি সন্তান প্রতিপালন, দাম্পত্য, সমাজসচেতনতা—প্রতিটি ক্ষেত্রে ফাতিমীয় পথ অনুসরণ করেন, তবে তার ঘর জান্নাতে পরিণত হবে, প্রজন্ম নিরাপদ থাকবে, সমাজ সুশৃঙ্খল হবে এবং নারী তার হারানো মহিমা পুনরায় ফিরে পাবে।
হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবসের বার্তা হলো—
নারী পৃথিবীতে বসবাস করেও আসমানীয় হতে পারে।
দ্রষ্টব্য: সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে, যেখানে একই বিষয়ে পরবর্তী বিশদ আলোচনা থাকবে।
আপনার কমেন্ট