শুক্রবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১১:৪৭
আখিরাত অস্বীকারকারীর প্রতি কুরআনের যুক্তিনিষ্ঠ ও বিস্ময়কর জবাব

আখিরাত—মানুষের জীবনের সবচেয়ে মৌলিক ও পরিণতিময় বাস্তবতা। অথচ ইতিহাসের শুরু থেকেই একদল মানুষ এই সত্যকে অস্বীকার করে এসেছে, যুক্তি ও উপহাসের আড়ালে লুকিয়ে নিজেদের জবাবদিহি থেকে মুক্ত থাকতে চেয়েছে। কুরআন কারিম তাদের এই অস্বীকৃতির মোকাবিলা করেছে আবেগ দিয়ে নয়, বরং গভীর যুক্তি, বাস্তব দৃষ্টান্ত ও মানব বুদ্ধির স্বাভাবিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে। সূরা ইয়াসিনের আলোচ্য আয়াতগুলোতে আখিরাত অস্বীকারকারীর একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে জবাব পেশ করা হয়েছে, তা কেবল ধর্মীয় বক্তব্য নয়—বরং চিন্তাশীল মানুষের জন্য এক বিস্ময়কর বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই প্রবন্ধে আখিরাত অস্বীকারকারীর প্রতি কুরআনের যুক্তিনিষ্ঠ ও বিস্ময়কর জবাব তুলে ধরছি:

প্রশ্ন: কুরআন কীভাবে আখিরাত অস্বীকারকারীদের যুক্তির জবাব দেয়?

সংক্ষিপ্ত উত্তর: এক ব্যক্তি পচে যাওয়া একটি হাড় হাতে নিয়ে আখিরাত অস্বীকার করতে এসে নবী (সা.)–কে প্রশ্ন করেছিল—কে এই হাড়গুলোকে আবার জীবিত করবে? কুরআন তার উত্তরে বলে: যে আল্লাহ সবুজ গাছ থেকে আগুন সৃষ্টি করেন এবং মানুষ সেই আগুন জ্বালায়, তিনিই এই পচে যাওয়া হাড়গুলোকেও আবার জীবনের পোশাক পরাতে সক্ষম। এরপর কুরআন ঘোষণা করে—সব কিছুর সার্বভৌম কর্তৃত্ব যাঁর হাতে, তিনি সব ধরনের দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

বিস্তারিত উত্তর: তাফসিরসমূহে বর্ণিত হয়েছে—উবাই ইবন খালাফ, উমাইয়া ইবন খালাফ বা আস ইবন ওয়াইল নামের এক মুশরিক একটি পচে যাওয়া হাড় কুড়িয়ে পায়। সে মনে করে, এই “দৃঢ় প্রমাণ” দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)–এর সঙ্গে বিতর্কে নামবে এবং আখিরাতের ধারণাকে ভেঙে দেবে। সে হাড়টি হাতে নিয়ে নবী (সা.)–এর কাছে আসে, এমনকি হাড় গুঁড়ো করে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে বলে— এই পচে যাওয়া হাড়গুলোকে আবার কে জীবিত করতে পারে?”

এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইয়াসিনের ৭৭–৮৩ নম্বর আয়াত নাজিল হয় এবং এক অনবদ্য, যুক্তিসংগত ও অকাট্য উত্তর প্রদান করে।

১. মানুষের নিজের সৃষ্টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া
কুরআন প্রথমেই মানুষকে তার নিজের সৃষ্টির সূচনালগ্নের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—

 أَوَلَمْ يَرَ الْإِنسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৭৭)

অর্থাৎ— মানুষ কি দেখে না যে আমি তাকে এক ফোঁটা তুচ্ছ বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি? অথচ আজ সে এমন শক্তিশালী ও সচেতন যে প্রকাশ্যভাবে তার প্রতিপালকের সঙ্গেই বিতর্কে লিপ্ত হয়।

২. মানুষের বিস্মৃতি ও অহংকার
মানুষ নিজের সৃষ্টি ভুলে যায় এবং বলে—

 وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ ۖ قَالَ مَن يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৭৮)

অর্থাৎ— সে আমার জন্য উদাহরণ দাঁড় করায়, অথচ নিজের সৃষ্টিই ভুলে যায়। বলে: কে এই হাড়গুলোকে জীবিত করবে, যখন এগুলো সম্পূর্ণ পচে গেছে?

৩. প্রথম সৃষ্টি থেকেই পুনরুত্থানের যুক্তি
আল্লাহ নবীকে নির্দেশ দেন—

 قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৭৯)

অর্থাৎ— বলো, তিনিই এগুলোকে জীবিত করবেন, যিনি প্রথমবার এগুলো সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি প্রতিটি সৃষ্টির ব্যাপারে সর্বজ্ঞ।

যে সত্তা মানুষকে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর জন্য পচে যাওয়া হাড়ে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া আরও সহজ।

৪. সবুজ গাছ থেকে আগুন—এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত
এরপর কুরআন বাস্তব উদাহরণ দেয়—

 الَّذِي جَعَلَ لَكُم مِّنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنتُم مِّنْهُ تُوقِدُونَ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮০)

অর্থাৎ— তিনি তোমাদের জন্য সবুজ গাছ থেকেই আগুন সৃষ্টি করেছেন, আর তোমরা তা দিয়ে আগুন জ্বালাও।

যে সত্তা সিক্ত ও সবুজ বস্তু থেকে আগুন বের করতে পারেন, তিনি কি পচে যাওয়া হাড়ে প্রাণ দিতে অক্ষম?

৫. মহাবিশ্বের সৃষ্টি— পুনঃসৃষ্টির চূড়ান্ত প্রমাণ

 أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُم ۚ بَلَىٰ وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮১)

অর্থাৎ— যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি মানুষের মতো সৃষ্টিকে আবার সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? অবশ্যই সক্ষম। তিনি তো সর্বজ্ঞ মহাস্রষ্টা।

৬. আল্লাহর আদেশ—“হও, হয়ে যায়”

 إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮২)

অর্থাৎ— তিনি যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন শুধু বলেন: “হও”—আর তা সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়।

৭. চূড়ান্ত উপসংহার
সূরা ইয়াসিনের শেষ আয়াতে বলা হয়—

 فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

(সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৮৩)

অর্থাৎ— অতএব পবিত্র ও মহান সেই সত্তা, যার হাতে সব কিছুর সার্বভৌম কর্তৃত্ব। আর তোমাদের সবাইকেই তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

যাঁর হাতে সমগ্র সৃষ্টিজগতের নিঃশর্ত ক্ষমতা, তিনি সব ধরনের অক্ষমতা থেকে মুক্ত। তাই পচে যাওয়া হাড়ে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা ছড়িয়ে-পড়া ধূলিকণাকে একত্র করা তাঁর জন্য মোটেও কঠিন নয়। সুতরাং আখিরাত অবশ্যম্ভাবী সত্য— এ এক অস্বীকারযোগ্য বাস্তবতা।

অতএব, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়—সকলেরই তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন ঘটবে, আর আখিরাত অবশ্যম্ভাবী সত্য।

পাদটীকা

১. “খাসীম (خَصِيم)” সেই মানুষকে বোঝায়, যে বিরোধিতা ও বিতর্কে অনমনীয়—যার স্বভাবেই তর্কপ্রবণতা ও বিরুদ্ধাচরণ লুকিয়ে থাকে। আর এখানে ব্যবহৃত “রুয়্যাত (رؤيت)” শব্দটি কেবল চোখে দেখাকে নির্দেশ করে না; বরং জানা, উপলব্ধি করা ও সচেতনভাবে উপলব্ধি করার গভীর অর্থ বহন করে।

২. রামীম (رَمِيم)” শব্দটি এসেছে “রম (رَمّ)” ধাতু থেকে। বিখ্যাত ভাষাবিদ রাগিব ইসফাহানি তাঁর মুফরাদাতুল কুরআন গ্রন্থে লিখেছেন—এই ধাতুর মূল ভাবার্থ হলো জীর্ণ, ক্ষয়প্রাপ্ত ও ভগ্ন অবস্থায় পৌঁছানো বস্তুকে জোড়া লাগানো বা মেরামত করা। বিশেষ অর্থে “রিম্মাহ (رِمّة)” বলা হয় পচে যাওয়া হাড়কে, আর “রুম্মাহ (رُمّة)” বলা হয় সেই দড়িকে, যা পুরোনো হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

৩. এই আলোচনা সংগৃহীত হয়েছে প্রখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ— গ্রন্থ: তাফসিরে নমুনা থেকে | মুফাসসির: আয়াতুল্লাহ আল-উযমা নাসের মাকারেম শিরাজি | প্রকাশনা: দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়া | সংস্করণ: ছাব্বিশতম মুদ্রণ, খণ্ড: ১৮, পৃষ্ঠা: ৪৮০

মূল সূত্র: আইনে রহমত

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha