হাওজা নিউজ এজেন্সি: খোদ ইরানের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে কিছু সরলীকৃত বিশ্লেষণ চোখে পড়ে যেখানে বলা হয়— যদি ইরান ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার এবং সমৃদ্ধকরণের অধিকার ছেড়ে দেয় বা দিত, তবে ইউরোপ “স্ন্যাপব্যাপ মেকানিজম” সক্রিয় হত না এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনঃআরোপিত হত না। কিন্তু এই যুক্তি যতটা সরল, বাস্তবতা ততটাই জটিল। ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সমস্যা শুধু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নয়; এর গভীরে রয়েছে ইরানের ধর্মীয় পরিচয়, স্বাধীনতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি।
পারমাণবিক চুক্তির পতন ও নতুন ষড়যন্ত্র
এক দশকের উত্থান–পতনের পর যখন বারজাম (পারমাণবিক চুক্তি) প্রায় শেষের পথে, তখন জায়নিস্ট শাসন আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালায় কিন্তু দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে তারা ভয়াবহ জবাব পায়। কিন্তু সে ব্যর্থতার পর তারা নতুন করে “স্ন্যাপব্যাপ মেকানিজম” সক্রিয় করে ইরানের ওপর চাপ বাড়ানোর ষড়যন্ত্রে নেমেছে।
তাদের মূল লক্ষ্য ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল ও ধ্বংস করা। তবে গৌণ লক্ষ্যও স্পষ্ট—ইরানের বৈজ্ঞানিক অর্জন ও পারমাণবিক শিল্পকে ভেঙে ফেলা।
ইরানের অভ্যন্তরীণ সরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি
ইরানের ভেতরে কিছু মহল পশ্চিমা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন তোলে—“ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের দরকার কী?” অথবা বলে যে—“৪০০ কেজি ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ছেড়ে দিলে ইউরোপ স্ন্যাপব্যাপ মেকানিজম চালু করত না।”
কিন্তু এই বিশ্লেষণ অতিমাত্রায় সরলীকৃত। প্রথমত, একসময় পশ্চিমপন্থীরা দাবি করেছিল—“আমরা অন্তত ইরানের সমৃদ্ধকরণের অধিকার রক্ষা করেছি।” অথচ আজ তারা বলছে—“সমৃদ্ধকরণ ইরানের কোনো কাজে আসে না।” দ্বিতীয়ত, যদি পশ্চিমাদের সমস্যা সত্যিই শুধু সমৃদ্ধকরণ হতো, তবে কেন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়—যখন ইরান না পারমাণবিক কর্মসূচি ছিল, না কোনো পক্ষ নিয়েছিল—তবুও পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরান দখল করে নিয়েছিল এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে লাখো ইরানি প্রাণ হারিয়েছিল? কিন্তু পশ্চিমপন্থীরা এ ঐতিহাসিক সত্যকে উপেক্ষা করে আজও বলে—“সব দোষ ইরানের।”
আমেরিকার ব্যয়বহুল শত্রুতা
তারা কি একবারও ভেবে দেখে—যদি সমস্যা শুধু ইউরেনিয়াম হতো, তবে কেন আমেরিকা বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিশেষ বোমা বানায়, ফোর্দো ভাঙার পরিকল্পনা করে, বিশাল বোমারু বিমান পাঠায়?
যদি এত খরচ করতেই হয়, তবে কেন সেই অর্থ ইরানের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা হিসেবে দেয় না, যাতে ইরান সমৃদ্ধকরণ থেকে সরে দাঁড়ায়?
আসলে ইরান অতীতে সরে আসার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে—ব্রাজিল ও তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে পারমাণবিক চুক্তি পর্যন্ত। কিন্তু ফলাফল কী? শেষ পর্যন্ত সামরিক হুমকি ও হামলাই এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা ও পশ্চিমাদের আসল সমস্যা ইউরেনিয়াম নয়, বরং ইরানের স্বাধীনতা, ধর্মীয় পরিচয় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি।
ইতিহাসের শিক্ষা: জাপানের উদাহরণ
এই সত্য বোঝার জন্য কেবল জাপানের ইতিহাসে চোখ রাখলেই যথেষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপান কার্যত আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিল। তবুও আমেরিকা শুধু একটি নয়, দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলল। কেন? কারণ আমেরিকার লক্ষ্য ছিল জাতিকে সম্পূর্ণভাবে ভয় দেখিয়ে বশে আনা।
আজও একই কৌশল চলছে—কখনও মানবাধিকার, কখনও পারমাণবিক কর্মসূচি, কখনও ক্ষেপণাস্ত্র বা প্রতিরোধ ফ্রন্টের অজুহাত তুলে চাপ সৃষ্টি করা।
পারমাণবিক জ্ঞানের প্রকৃত মূল্য
বিশ্বের সব দেশই পারমাণবিক শক্তি ও জ্ঞান ব্যবহার করছে। পশ্চিম ইরানকে এ থেকে বঞ্চিত করতে চায়, কিন্তু তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। শহিদ বিজ্ঞানীদের রক্ত বৃথা যায়নি। নতুন প্রজন্মের আরও দক্ষ বিজ্ঞানী তৈরি হয়েছে এবং কোটি ইরানি ইতিমধ্যেই এর সুফল পাচ্ছে।
পশ্চিমপন্থীরা যদি বলে পারমাণবিক কর্মসূচির কোনো সাফল্য নেই, তবে তা নিছক অজ্ঞতা বা কথার কথা। অতীতে যেমন কিছু লোক বলেছিল—“তেলেরই দরকার নেই, খরচ বেশি।” অথচ আজ তেলের গুরুত্ব বিশ্বজুড়ে সুস্পষ্ট।
কেন পারমাণবিক শিল্প একটি “মাদার ইন্ডাস্ট্রি”
পারমাণবিক শিল্পকে বলা হয় “মাদার ইন্ডাস্ট্রি” বা মূল শিল্প, কারণ এটি বহু শাখার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এবং একসাথে অন্য সব খাতকে অগ্রসর করে। এর প্রতিটি উপাদান নিজস্বভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, একত্রে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক–শিল্প ইকোসিস্টেম তৈরি করে।
পারমাণবিক শিল্পের প্রধান উপাদানসমূহ
• পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান → আইসোটোপ পৃথকীকরণ,
• ইউরেনিয়াম–২৩৫ ও ২৩৮–এর বৈশিষ্ট্য বোঝা, বিকিরণ ও নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার জ্ঞান।
• যন্ত্র প্রকৌশল → অত্যন্ত উচ্চ–নির্ভুল সেন্ট্রিফিউজ ও জটিল যান্ত্রিক সরঞ্জাম তৈরি।
• উপাদান বিজ্ঞান ও ধাতুবিদ্যা → বিকিরণ–সহনশীল নতুন ধাতু, অ্যালয় ও যৌগ তৈরি যা অন্য শিল্পেও প্রয়োগযোগ্য।
• বিদ্যুৎ ও নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশল → উন্নত সেন্সর, অটোমেশন সিস্টেম ও নির্ভুল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নয়ন।
• ভ্যাকুয়াম প্রযুক্তি ও ন্যানোপ্রযুক্তি → সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্তরে নির্ভুল নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
সামগ্রিক প্রভাব
এই সমস্ত শাখার সমন্বয়ে পারমাণবিক শিল্প শুধু শক্তি উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, প্রতিরক্ষা, এমনকি মহাকাশ প্রযুক্তিতেও এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। এ কারণে একে বলা হয় “প্রযুক্তির প্রযুক্তি”, যা একটি দেশের স্বাধীনতা, বৈজ্ঞানিক শক্তি ও শিল্পায়নের মূল ভিত্তি গড়ে তোলে।
ব্যবহারিক সুফল
• গবেষণা রিঅ্যাক্টরের জন্য জ্বালানি উৎপাদন।
• চিকিৎসা ও শিল্পে প্রয়োজনীয় রেডিওআইসোটোপ উৎপাদন (যার ওপর বছরে এক মিলিয়নের বেশি ইরানি রোগী নির্ভরশীল, বিশেষত ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্নায়বিক সমস্যার চিকিৎসায়)।
• ২০%–এর বেশি সমৃদ্ধকরণে উচ্চশক্তি রিঅ্যাক্টরের জ্বালানি তৈরি।
• কৃষি ও শিল্পে বিকিরণ প্রযুক্তি।
• পারমাণবিক উপজাত ইউরেনিয়ামের উচ্চ ঘনত্বের কারণে জাহাজ, বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রভৃতি খাতে ব্যবহার।
• ক্ষুদ্র স্কেলের উচ্চশক্তি রিঅ্যাক্টর তৈরি, যেমন—ডুবোজাহাজ বা ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রতিটি স্তরে সমৃদ্ধকরণ নতুন বৈজ্ঞানিক ও শিল্প সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে।
আমেরিকা ও পশ্চিমাদের সমস্যা কেবল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নয়। তাদের আসল উদ্দেশ্য ইরানের স্বাধীনতা, ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক পরিচয় ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি দমন করা। তাই পারমাণবিক কর্মসূচি ইরানের জন্য কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন বা চিকিৎসা নয়—এটি আত্মনির্ভরতা, জাতীয় পরিচয়, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রতীক।
আপনার কমেন্ট