মঙ্গলবার ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৪:৫৯
ইমাম খোমেনী (রহ.) জীবনের শেষ সময়ে কেন ‘বাসিজে তুল্লাব’ গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন?

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান স্থপতি ইমাম খোমেনী (রহ.) জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘বাসিজে তুল্লাব ও রুহানিয়্যুন’ প্রতিষ্ঠার— যে ঐতিহাসিক নির্দেশ দিয়েছিলেন— তা শুধু তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া ছিল না; বরং ইরানসহ সমগ্র ইসলামী সমাজের ভবিষ্যৎ চিন্তাগত ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার জন্য এক সুদূরদর্শী উদ্যোগ ছিল।

দেশটির ধর্মীয় নগরী কোমে অবস্থানরত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাসিজে তুল্লাব ও রুহানিয়্যুনের বর্তমান প্রধান হুজ্জতুল-ইসলাম মাহদি জোশকানিয়ান হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পটভূমি ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন।

যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন চ্যালেঞ্জ: ‘নরম যুদ্ধ’ ও চিন্তাগত আগ্রাসন
হুজ্জাতুল ইসলাম জোশকানিয়ান জানান, ইরাক–ইরান যুদ্ধের পর ইমাম খোমেনী (রহ.) উপলব্ধি করেন যে ভবিষ্যতের আর সামরিক যুদ্ধ হবে না— বরং শুরু হবে ফিকরি (চিন্তাগত), সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া আক্রমণের মাধ্যমে।
এই কারণেই তিনি মাদ্রাসা-শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং রুহানিয়্যুনদের সমন্বয়ে ‘বাসিজে তুল্লাব’ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন, যাতে নতুন ধরনের এই নরম যুদ্ধ (Soft War)-এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরক্ষা দাঁড় করানো যায়।

ইমামের দৃষ্টিতে একটি বিপ্লব টিকে থাকে দুই স্তম্ভে—

১. সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ (বসিজে আম্)

২. এবং নেতৃত্বশীল, চিন্তাশীল ও শিক্ষিত শ্রেণির সুসংগঠিত উপস্থিতি

‘বাসিজে তুল্লাব’ ছিল এই দ্বিতীয় স্তম্ভকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ।

“নখবা-ভিত্তিক বাসিজ”: ইমাম খোমেনীর কৌশলগত দৃষ্টি
হুজ্জাতুল ইসলাম জোশকানিয়ান উল্লেখ করেন, ইমাম (রহ.) চেয়েছিলেন সমাজের সেই শ্রেণিকে— যারা জ্ঞান, চিন্তা, দাওয়াত ও ধর্মীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত—এক সাংগঠনিক শক্তিতে পরিণত করতে।
তাই তিনি তুল্লাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং রুহানিয়্যুন—এই তিন শ্রেণিকে একত্র করে ‘বাসিজে তুল্লাব’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন।

এর লক্ষ্য ছিল:
• ইসলামী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ও আদর্শিক ভিত্তি সুরক্ষিত রাখা
• নতুন প্রজন্মকে ইনকিলাবি চেতনা ও সঠিক ফিকরি (চিন্তা) দিকনির্দেশনা প্রদান
• সমাজ, মিডিয়া ও একাডেমিক অঙ্গনে চিন্তার প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা

বর্তমান কাঠামো: ১১টি হাওজায়ে মুকাওমাত এবং ১১৫টি কার্যকর কেন্দ্র
বর্তমানে কোমে ‘বাসিজে তুল্লাব ও রুহানিয়্যুন’ অত্যন্ত সক্রিয় ও বিস্তৃত নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে।

হুজ্জাতুল ইসলাম জোশকানিয়ানের তথ্য অনুযায়ী, এতে রয়েছে—
• ১১টি হাওজায়ে মুকাওমাত (প্রতিরোধ ইউনিট)
• ১১৫টি পয়গাহ (কার্যকর কেন্দ্র)
এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় প্রচার, সামাজিক সেবা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিপ্লবের লক্ষ্য সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের ফিকরি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

মূল দায়িত্ব: ফিকরি প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও সেবা-কার্য
হুজ্জাতুল ইসলাম জোশকানিয়ান বলেন, আজকের বাসিজে তুল্লাব শুধু পাঠদান বা প্রচারেই সীমিত নয়; বরং—
• হাওজায়ে ইলমিয়ার ইনকিলাবি রূহ সুরক্ষা
• তরুণ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক-আদর্শিক প্রশিক্ষণ
• ডিজিটাল ও মিডিয়া অঙ্গনে সক্রিয় উপস্থিতি
• সমাজে মানবিক সেবা ও সমস্যার সমাধানমূলক কার্যক্রম
• এবং ধর্মীয় প্রচারকে সমসাময়িক ও প্রভাবশালী রূপ দেওয়া

তিনি বলেন, “চিন্তা ও সংস্কৃতির এই যুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর ঢাল হলো—সুশিক্ষিত, সংগঠিত ও দায়িত্বশীল তুল্লাব।”

ভবিষ্যৎ অঙ্গীকার
হুজ্জাতুল ইসলাম জোশকানিয়ান ঘোষণা করেন যে কোমের বাসিজে তুল্লাব ও রুহানিয়্যুন আগামীতেও—
• দাওয়াত,
• ফিকরি প্রতিরক্ষা,
• গণমাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি,
• এবং জনসেবামূলক কর্মসূচি— এসব ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।

ইমাম খোমেনী (রহ.) জীবনের শেষ সময়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—সমাজের শিক্ষিত ও ধর্মীয় নেতৃত্বের শ্রেণিকে ‘বাসিজে তুল্লাব’ হিসেবে সংগঠিত করা— তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
নতুন যুগের ফিকরি ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের মোকাবেলায় এই সংগঠন হয়ে উঠেছে ইসলামী বিপ্লবের চিন্তাগত নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha