শুক্রবার ১৭ অক্টোবর ২০২৫ - ১২:০৩
সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা: সুশিক্ষিত ও সচেতন প্রজন্ম গঠনের মূলভিত্তি

সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা (Cultural Literacy) কেবল মিডিয়া সাক্ষরতার পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এমন এক সমন্বিত জ্ঞানব্যবস্থা, যা বর্তমান প্রজন্মের শিশু ও কিশোরদের ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে সচেতন, দায়িত্বশীল ও নৈতিকভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের পৃথিবীতে এমন এক শিক্ষাবোধের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যা মিডিয়া সাক্ষরতার সীমা ছাড়িয়ে সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও সামাজিক অনুধাবনকে একত্রে ধারণ করে— আর এটি হলো সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা।

এটি কেবল পড়া ও লেখার দক্ষতা নয়; বরং সমাজ, যোগাযোগ, গণমাধ্যম ও পাঠ্যবস্তুর গভীর অর্থ অনুধাবনের জন্য প্রয়োজনীয় অভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের উপলব্ধি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ব্যক্তি সাংস্কৃতিক সাক্ষরতায় সমৃদ্ধ, তিনি কেবল তথ্যগ্রাহী নন, বরং অর্থবোধ ও মূল্যবোধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তিনি কোনো বার্তার শুধু সরল অর্থই বোঝেন না, বরং তার অন্তর্নিহিত বা গোপন তাৎপর্যও অনুধাবন করতে পারেন, যা তাকে সমাজে আরও সংবেদনশীল ও কার্যকর নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

শিশুদের শিক্ষায় সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার অপরিহার্যতা
নতুন প্রজন্মের জন্য সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার গুরুত্ব এখানেই যে, এটি শিশুদের শেখায় কেবল “কি পড়বে” তা নয়, বরং “কীভাবে পৃথিবীকে বোঝা ও বিশ্লেষণ করা যায়”।

সাংস্কৃতিক গবেষক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ মাহদি সাইয়্যেদ নাসেরি বলেন, “আজকের শিশু জাতীয় গল্প, লোককথা বা ঐতিহ্যবাহী কবিতা শোনার আগেই আন্তর্জাতিক অ্যানিমেশন, গেমস ও কল্পিত চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে—এবং সেই মাধ্যমেই তার চিন্তাশক্তি গড়ে উঠছে।”

ফলে এই প্রজন্ম মিডিয়াকে বোঝে, কিন্তু সংস্কৃতিকে বোঝে না। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে জানে, কিন্তু তার নৈতিক বা সাংস্কৃতিক অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না।

ড. নাসেরির মতে, এই ব্যবধান এক নীরব সাংস্কৃতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে—যেখানে “ডিজিটাল শিশু” প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ হলেও সাংস্কৃতিকভাবে অপূর্ণ। এটি কোনো নৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং সাংস্কৃতিক শিক্ষার ঘাটতি।

তিনি আরও বলেন, বহু বছর ধরে শিক্ষা ও গণমাধ্যমে “মিডিয়া সাক্ষরতা” শেখানো হলেও, তা মূলত প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা, বিশ্লেষণ ও তথ্য যাচাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু “সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা” শিশুদের শেখায় কীভাবে মিডিয়া ব্যবহারের মধ্য দিয়েও নিজের পরিচয়, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা যায়।

মিডিয়া সাক্ষরতা হলো হাতিয়ার, সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা হলো শিকড়
ড. নাসেরি একে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: “মিডিয়া সাক্ষরতা একটি হাতিয়ার, কিন্তু সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা হলো তার শিকড়।”

মিডিয়া আমাদের পৃথিবী দেখার জানালা খুলে দেয়, কিন্তু সংস্কৃতি নির্ধারণ করে আমরা সেই পৃথিবীকে কীভাবে দেখি। অর্থাৎ, সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা হলো এমন এক মানসিক ও নৈতিক শক্তি, যা একজন মানুষকে ডিজিটাল যুগে সচেতনভাবে বিচরণ করতে ও আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকতে শেখায়।

একজন কিশোর তখনই প্রকৃতভাবে সাক্ষর, যখন সে শুধু “কীভাবে পোস্ট দিতে হয়” তা নয়, বরং “কেন” এবং “কোন উদ্দেশ্যে” পোস্ট দিতে হয়, সেটিও বোঝে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের স্কুলগুলোতে “মিডিয়া সাক্ষরতা কর্মশালা” বা “নিরাপদ ইন্টারনেট প্রশিক্ষণ” থাকলেও, সেগুলো সাধারণত প্রযুক্তিগত শৃঙ্খলা শেখানোয় সীমিত থাকে।

আমরা শিশুদের বলি—নিজের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করো না, অপরিচিতদের জবাব দিও না, মোবাইলের সময় সীমিত রাখো।
কিন্তু খুব কমই শেখাই—
• কেন মিথ্যা সংবাদ শনাক্ত করা জরুরি,
• কীভাবে নিজের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হয়,
• অথবা সীমাহীন ডিজিটাল দুনিয়ায় থেকেও কীভাবে “নিজস্বতায়” এবং “মানবিক” থাকা যায়।

সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ছাড়া মিডিয়া সাক্ষরতা অন্ধ
ড. নাসেরির মতে, সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা না থাকলে মিডিয়া সাক্ষরতা একপ্রকার “অন্ধ হাতিয়ারে” পরিণত হয়—যা হয়তো প্রযুক্তিগত বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, কিন্তু “অ্যালগরিদমের নরম শাসন” ও বিদেশি জীবনধারার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে নয়।

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যখন কোনো শিশু প্রতিদিন এমন ভিডিও দেখে যেখানে সহিংসতা হাস্যরসের অংশ, ভোগবাদ এক ধরনের মূল্যবান, আর সেলিব্রিটির অনুকরণ গর্বের বিষয়—তখন সে কিন্তু স্কুল থেকে নয়, বরং অ্যালগরিদম থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।”

সম্প্রতি ইউনেস্কো প্রকাশিত “শিশুদের জন্য মিডিয়া ও ডিজিটাল সাক্ষরতা” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিটাল পরিসরে শিশুদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় সংরক্ষণই “সাংস্কৃতিক শিক্ষার অধিকার”-এর অন্যতম ভিত্তি।

এই সুরক্ষা না থাকলে শিশুরা কেবল তথ্যের ভোক্তা হয়ে ওঠে এবং ক্রমে নিজেদের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণের আহ্বান
বিশিষ্ট হাওজায়ে ইলমিয়া (মহিলা) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষক নারজেস শেকারজাদে বলেন—আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক সাক্ষরতাকে কেবল পাঠ্যবিষয় হিসেবে নয়, বরং একটি মৌলিক শিক্ষা নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

শিশুদের শেখাতে হবে—গণমাধ্যম কীভাবে চিন্তা গড়ে তোলে, গল্প নির্মাণ করে এবং কীভাবে নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।

তার মতে, এখন সময় এসেছে এমন এক শিক্ষামাধ্যম নির্মাণের, যা পৃষ্ঠস্থ ও পুনরাবৃত্ত বার্তার পরিবর্তে চিন্তাশীল, স্থানীয় মূল্যবোধসম্পন্ন এবং মাল্টিমিডিয়া-ভিত্তিক হবে—যা শিশু ও কিশোরদের বয়স, মানসিকতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মিসেস শেকারজাদে বলেন, “সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা মানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের দরজা বন্ধ করা নয়, বরং সচেতনতার সঙ্গে জানালা খোলা।”

আমাদের সন্তানরা বৈশ্বিক অগ্রগতির শিক্ষা নিতে পারে, তবে তাদের জানা দরকার—তারা পৃথিবীর কোথায় অবস্থান করছে, এবং কোন মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করছে।

তিনি আরও যোগ করেন, “সংস্কৃতির ভিত্তি ছাড়া মিডিয়া সাক্ষরতা শেখানো ঠিক যেন এমন সমুদ্রে সাঁতার শেখানো, যার গভীরতা আমরা নিজেরাই জানি না।”

পরিবারে সচেতনতা বৃদ্ধির অপরিহার্যতা
শেষে শেকারজাদে বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক প্রজন্ম গড়ে তোলা, যারা কেবল কোনো কন্টেন্টে ক্লিক করে না, বরং বিষয়গুলো বোঝে, বিশ্লেষণ করে এবং উপলব্ধি করে।”

শিশুদের ডিজিটাল শিক্ষার পূর্ণতা তখনই অর্জিত হবে, যখন তিনটি উপাদান একসঙ্গে বিকশিত হবে—

১. প্রযুক্তিগত জ্ঞান

২. সাংস্কৃতিক অনুধাবন

৩. নৈতিক দায়িত্ববোধ

এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সমাজ, বিশেষত পরিবারগুলোকে সচেতন করে তুলতে হবে যেন তারা সন্তানদের এমনভাবে লালন করতে পারে, যাতে তারা প্রযুক্তিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করে—কিন্তু কখনোই নিজেদের সংস্কৃতি, মানবিকতা ও পরিচয় হারিয়ে না ফেলে।

সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা কেবল একটি শিক্ষা নয়—এটি একটি চলমান সামাজিক অনুশীলন। যে সমাজ নিজের সংস্কৃতিকে জানে, সে সমাজই বৈশ্বিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে সক্ষম হয়।

তাই শিশু ও কিশোরদের শিক্ষায় সাংস্কৃতিক সাক্ষরতাকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সময়ের সবচেয়ে জরুরি দাবি।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha