সোমবার ৩ নভেম্বর ২০২৫ - ১৩:২০
হজরত ফাতিমা (সা.)-এর জীবনাদর্শ হোক আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের পথনির্দেশ

ফাতিমা (সা.)-এর জীবন ছিল সংগ্রাম, ধৈর্য, সেবা ও ত্যাগে পরিপূর্ণ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,


ভূমিকা


মানবজীবনের সর্বোত্তম আদর্শ খুঁজতে হলে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় সেইসব ব্যক্তিত্বের দিকে, যাঁরা নিজেদের জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের জীবনধারা কেবল ধর্মীয় নয়, নৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। তেমনই এক অনন্য মহীয়সী নারী হলেন নবী করিম (সা.)-এর কন্যা, ইমাম আলী (আ.)-এর স্ত্রী, চারজন শ্রেষ্ঠ নারীর অন্যতম-ফাতিমা জাহরা (সা.)। তাঁর জীবনযাপন, দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক আদর্শ আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের জন্য এক অসাধারণ দিকনির্দেশনা।
ফাতিমা (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হজরত ফাতিমা (সা.) জন্মগ্রহণ করেন মক্কায়, নবুওয়াতের আগের কিছু বছর আগে (প্রায় খ্রিস্টাব্দ ৬০৫ সালে)। তিনি ছিলেন মহানবী (সা.) ও হযরত খাদিজা (রা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা। ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতার নবুওয়াতি দায়িত্বের সাক্ষী ছিলেন, মক্কার কঠিন সময়ে বাবার পাশে ছিলেন ছায়ার মতো।
মদিনায় হিজরতের পর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সঙ্গে। তাঁদের ঘরে জন্ম নেন ইসলামের ইতিহাসের মহান দুই সন্তান-ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)।
ফাতিমা (সা.)-এর জীবন ছিল সংগ্রাম, ধৈর্য, সেবা ও ত্যাগে পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী, স্নেহময়ী মা, নিবেদিত কন্যা ও সমাজসচেতন নারী।
পারিবারিক জীবনে ফাতিমা (সা.)-এর আদর্শ
ফাতিমা (সা.)-এর পরিবার ছিল মানবতার শিক্ষার বিদ্যালয়। তাঁর পারিবারিক জীবন থেকে আমরা পাই কয়েকটি মৌলিক শিক্ষা-
ক- ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা
তিনি সর্বদা তাঁর স্বামী আলী (আ.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। পারিবারিক জীবনে পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়া ছিল তাঁদের সম্পর্কের ভিত্তি। একবার মহানবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, “ফাতিমা! তুমি আলীকে কেমন পাও?” তিনি বিনম্রভাবে বলেছিলেন, “আমি তাঁকে আল্লাহর দাস হিসেবে শ্রদ্ধা করি এবং স্বামী হিসেবে ভালোবাসি।”
খ- সাদাসিধে জীবনযাপন
ফাতিমা (সা.)-এর ঘর ছিল ধনসম্পদে নয়, বরং আল্লাহর জিকিরে সমৃদ্ধ। নিজের হাতে গৃহকর্ম করতেন, সন্তানদের লালনপালনে নিবেদিত ছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, শান্তি ও মর্যাদা ধনসম্পদে নয়, বরং তৃপ্তি ও ঈমানের মধ্যে নিহিত।
গ- ধৈর্য ও ত্যাগ
দারিদ্র্য, কষ্ট ও অন্যায়ের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো অভিযোগ করেননি। বরং আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট ছিলেন। এই গুণ আজকের পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়-ধৈর্য ও সহমর্মিতা ছাড়া সংসার টেকে না।
সামাজিক জীবনে ফাতিমা (সা.)-এর আদর্শ
ফাতিমা (সা.) কেবল গৃহবন্দী নারী ছিলেন না; তিনি ছিলেন সমাজসচেতন, ন্যায়প্রিয় ও সত্যের কণ্ঠস্বর।
ক- ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অবস্থান
খলিফা নির্বাচন-পরবর্তী অন্যায় ও সমাজের বিভ্রান্ত পরিস্থিতিতেও তিনি নীরব থাকেননি। ‘খুতবা-এ-ফাদাক’ তাঁর সাহসী উচ্চারণের প্রতীক, যেখানে তিনি ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
খ- গরীব ও অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি
একদিন রোজার অবস্থায় তিনি, আলী (আ.), হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.) তিন দিন ধারাবাহিকভাবে নিজেদের ইফতার গরীব, ইয়াতিম ও বন্দীর মধ্যে বিলিয়ে দেন, অথচ নিজেরা পানি খেয়ে রাত্রি কাটান। এ থেকেই বোঝা যায়-প্রকৃত সামাজিক দায়িত্ব কীভাবে পালন করতে হয়।
গ- নারীর মর্যাদা ও ভূমিকা
ফাতিমা (সা.) প্রমাণ করেছেন যে, নারীর আসল শক্তি তাঁর চরিত্র, জ্ঞান ও নৈতিকতার মধ্যে। তিনি ছিলেন সমাজের ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সক্রিয় অংশীদার, তবুও তাঁর বিনয় ও পর্দাশীলতা ছিল অনুকরণীয়।
আজকের প্রেক্ষাপটে ফাতিমা (সা.)-এর আদর্শের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান যুগে যখন পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে এবং মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, তখন ফাতিমা (সা.)-এর জীবনাদর্শ আমাদের জন্য এক পথনির্দেশক আলোকশিখা।
তিনি শেখান পরিবারে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা বজায় রাখতে।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন দরিদ্র ও নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবতা।
তাঁর জীবন আমাদের আহ্বান জানায় অহংকার, লোভ ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে।
উপসংহার
হযরত ফাতিমা (সা.) ছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্ট নারী-“ফাতিমা আমার অংশ, যাকে কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয়” (হাদিস: সহিহ বুখারি)। তাঁর জীবন ছিল কুরআনের বাস্তব প্রতিফলন।
যদি আমরা তাঁর জীবনকে অনুসরণ করি, তবে আমাদের পরিবারে ফিরে আসবে শান্তি, সমাজে আসবে ন্যায় ও সহানুভূতি।
অতএব, আজকের চ্যালেঞ্জপূর্ণ যুগে একমাত্র পথনির্দেশ হতে পারে 
“ফাতিমা (সা.)-এর জীবনাদর্শ হোক আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের পথনির্দেশ।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha