হাওজা নিউজ এজেন্সি: পারিবারিক বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রেজা ইউসুফজাদেহ “স্মার্টফোন ও ডিজিটাল জগতের প্রতি আসক্তির অনুভূতি” বিষয়টি একটি প্রশ্নোত্তর সেশনে আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনা পাঠকদের জন্য এখানে উপস্থাপন করা হলো:
প্রশ্ন: আমার মনে হয় আমি স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছি, এখন কী করব?
উত্তর: প্রথমেই বলতে হয়, স্মার্টফোন ও ডিজিটাল জগতে আসক্তি একটি সুস্পষ্ট বাস্তবতা। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, কম্পিউটার গেম ও ইন্টারনেটের আসক্তি মস্তিষ্কে ঠিক সেই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা হেরোইনের মতো মাদকের আসক্তিতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং ইন্টারনেট ও ডিজিটাল জগতের আসক্তি পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিক মানের টেস্টও রয়েছে।
পাশাপাশি, বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে চীন, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মিডিয়া আসক্তি দূর করার বিশেষায়িত কেন্দ্র সক্রিয় রয়েছে। এসব কেন্দ্র চিকিৎসার বিভিন্ন মডেল এবং বিশেষ রিহ্যাব সেন্টার বা ক্যাম্পের সুবিধা দেয়।
মানসিক ব্যাধি ও জবরদস্তিমূলক আসক্তি সংক্রান্ত ডিএসএম (DSM) হ্যান্ডবুকেও এই ধরনের নির্ভরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এটি এখনও একটি আনুষ্ঠানিক মানসিক ব্যাধি হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, তবে ভবিষ্যত সংস্করণে একে আনুষ্ঠানিক মানসিক ব্যাধির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
তাই, এ নিয়ে “আসক্ত” এর তকমা লাগানো হবে ভেবে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি নিজেও যখন এ বিষয়টি চিন্তা করি, কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করি। তবে আমাদের অবশ্যই সাধারণ বেশি ব্যবহার আর প্রকৃত আসক্তির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।
সাধারণ বেশি ব্যবহার ও প্রকৃত আসক্তির মধ্যে পার্থক্য: প্রকৃত আসক্তি বলতে বোঝায় জবরদস্তিমূলক ব্যবহার; অর্থাৎ, ব্যবহারকারী স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ করতে পারেন না, এমনকি দুই মিনিটের জন্যও তা থেকে দূরে থাকতে পারেন না।
অন্যদিকে, বেশি ব্যবহার বলতে শুধু ফোনে দীর্ঘ সময় কাটানোকে বোঝায়, যা তখনও নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকে এবং তা অগত্যা আসক্তি বোঝায় না।
তাই, আমাদের নিজের বা সন্তানদের সহজে “আসক্ত” বলে তকমা দেওয়া উচিত নয়। প্রকৃত আসক্তি একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাধি, যার নির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে। কেবল সেই লক্ষণগুলো উপস্থিত থাকলেই বলা যায় ব্যক্তি আসক্ত।
স্মার্টফোন ও ডিজিটাল জগতের প্রতি নির্ভরতার কারণ:
ক. মানসিক চাপ থেকে পলায়ন: মানসিক চাপ, ক্লান্তি, অলসতা বা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে ফোনের শরণাপন্ন হওয়া।
খ. পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক (FOMO): কোনো আপডেট বা খবর মিস করে ফেলার ভয়ে সামাজিক মাধ্যম ও নিউজ ফিড নিয়মিত চেক করার তাগিদ। এটি এক ধরনের বিশেষ আতঙ্ক।
গ. ডিজিটাল জগতের বহুমুখী আকর্ষণ: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে designed যেখানে একইসাথে নানাবিধ উপাদান ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করে ও আটকে রাখে।
স্মার্টফোন ও ডিজিটাল জগতের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী উপায়:
১. মিডিয়া সম্পর্কে স্ব-সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রতিদিন কোন কোন অ্যাপ বা কাজে কত সময় ব্যয় করছেন, তার একটি লিখিত তালিকা করুন। ফোনের ডিজিটাল ওয়েলবিং টুলস ব্যবহার করে আপনার দৈনিক ও মাসিক ব্যবহারের গড় সময় দেখুন। এই স্ব-সচেতনতা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ভিত্তি গড়ে দেবে।
২. অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করা: সব অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন অথবা ফোনটি সাইলেন্ট মোডে রাখুন। এতে প্রতি মুহূর্তে ফোন চেক করার বাধ্যবাধকতা কমবে।
৩. ফোনবিহীন সময় নির্ধারণ: দিনের একটি নির্দিষ্ট অংশ (যেমন- এক থেকে দুই ঘন্টা) সম্পূর্ণ ফোন ছাড়া কাটান। এমনকি আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার জন্য ফোনটি ফ্লাইট মোডে রাখলেও মনোযোগ বাড়ে এবং ফোনের প্রতি নির্ভরতা কমে।
৪. সুনির্দিষ্ট সীমা ও সময় ব্যবস্থাপনা: ফোন ব্যবহারের জন্য আগে থেকে একটি সময়সূচি ঠিক করুন এবং শুধু সেই সময়ের মধ্যেই সেটি ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। এতে অপ্রয়োজনীয় ও উদ্দেশ্যহীনভাবে ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা যাবে।
সুতরাং, আপনি যদি উপরের পদ্ধতিগুলো মেনে চলার পরও দেখেন যে ফোনের ব্যবহার আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং নির্ভরতা আরও তীব্র হচ্ছে, তবে সেটি প্রকৃত আসক্তির একটি প্রাথমিক সতর্কসংকেত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আপনার কমেন্ট