বুধবার ২৬ নভেম্বর ২০২৫ - ১৬:৩৮
কেন আহলে বাইতের ইমামগণ (আ.) কোনো কিতাব রচনা করেননি?

শিয়া ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বের একটি প্রাচীন ও মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে— আহলুল বাইত (আ.)—যাঁদের হৃদয়ে লাদুন্নী জ্ঞানের অফুরন্ত ঝরনা বইত—তাঁরা কেন নিজ হাতে কোনো গ্রন্থ রচনা করলেন না?

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মদ আব্বাসি তাঁর মতে, এই « কিতাব না লেখার নীতি» (سیاست ننوشتن کتاب) ছিল আহলুল বাইতের অত্যন্ত দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় কৌশল—যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শিয়া সম্প্রদায়কে চিরকালের জন্য «دومین قرآن» বা (দ্বিতীয় কুরআন) সৃষ্টির অভিযোগ থেকে রক্ষা করা।

শিয়া গবেষণার আকাশে একটি প্রশ্ন তারার মতো জ্বলজ্বল করে: যাঁরা ছিলেন জ্ঞানের জীবন্ত ভাণ্ডার, যাঁদের প্রতিটি শব্দ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত, সেই আহলুল বাইত (আলাইহিমুস সালাম) কেন উলুল আযম নবীদের মতো নিজেদের হাতে কোনো স্বতন্ত্র, লিখিত গ্রন্থ রেখে যাননি? এতে কি উম্মত তাঁদের অমূল্য জ্ঞান-সমুদ্র থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল না?

এই প্রশ্নের গভীরে প্রবেশ করে হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মদ আব্বাসি এক অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর সাক্ষাৎকারের সারাংশ আমরা এখানে সুন্দর ও প্রবাহমান ভাষায় তুলে ধরছি:

প্রশ্ন: এত অপার জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমাদের ইমামগণ কেন নিজেদের হাতে কোনো কিতাব লিখে যাননি?

উত্তর: বিসমিল্লাহির র’হমানির র’হিম। এর উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমেই ফিরে যেতে হবে পবিত্র কুরআনের দিকে। আল্লাহ তা‘আলা শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-কেই সম্বোধন করে বলেছেন:

وَمَا كُنتَ تَتْلُو مِن قَبْلِهِ مِن كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ ۖ إِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ

[সূরা আল-আনকাবূত: ৪৮]

তুমি এর আগে কখনো কোনো গ্রন্থ পাঠ করতে না, আর নিজের ডান হাত দিয়ে কিছুই লেখোনি। যদি তাই করতে, তাহলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত।

অর্থাৎ, যদি নবী করিম (সা.) নিজে লিখতে-পড়তে জানতেন, তবে শত্রুরা বলে বেড়াত: “যাকে তুমি ওহী বলছো, তা আসলে তোমার নিজের রচনা। কিন্তু তিনি ছিলেন উম্মী—প্রচলিত শিক্ষায় অশিক্ষিত। ফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাঁর জ্ঞান কোনো মানুষের শেখানো নয়; বরং স্বয়ং আল্লাহর দান। কুরআন নিজেই বলে: عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى —তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন মহাপরাক্রমশালী সত্তা।

এই একই প্রজ্ঞা ও সতর্কতা আহলুলবাইত (আ.)-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

হুজ্জাতুল ইসলাম আব্বাসি বলেন, “যদি ইমামগণ নিজেদের হাতে কোনো গ্রন্থ রচনা করতেন, তবে বিরোধীরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠত: ‘দেখো! শিয়ারা কুরআনের পাশে আরেকটা কিতাব তৈরি করেছে!’

কল্পনা করুন— যদি কারও হাতে ‘কিতাবে ইমাম সাদিক (আ.)’ বা ‘মুছান্নাফে আমিরুল মু’মিনীন (আ.)’ নামে একটা বই দেখা যেত, তবে অভিযোগের ঝড় উঠত: ‘শিয়ারা কুরআন ছেড়ে অন্য গ্রন্থের অনুসারী হয়ে গেছে!’ এই অপবাদ ছড়িয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্মবিকৃতি, বিভ্রান্তি ও কুফরের ফতোয়া দেওয়া কত সহজ হয়ে যেত!

সুতরাং ইমামগণ (আ.) ইচ্ছাকৃতভাবে, অত্যন্ত গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে নিজেদের হাতে কিছুই লিখলেন না—যাতে কিয়ামত পর্যন্ত কেউ শিয়াদের ওপর «দ্বিতীয় কুরআন» সৃষ্টির অভিযোগ তুলতে না পারে।

কিন্তু জ্ঞান কি লিখে রাখা উচিত নয়?
হ্যাঁ, নবী ও ইমামগণ নিজেরাও বলেছেন: «قَيِّدُوا الْعِلْمَ بِالْكِتَابَةِ» “জ্ঞানকে লেখার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখো।

তাহলে সমাধান কী ছিল?
এখানেই প্রকাশ পায় আহলুলবাইতের অসামান্য দূরদর্শিতা। তাঁরা নিজেরা লেখেননি, কিন্তু—
• বিশ্বস্ত শিষ্য তৈরি করেছেন

• দিনরাত পাঠদান করেছেন

• সেই শিষ্যরাই তাঁদের প্রতিটি বাণী যত্নে লিপিবদ্ধ করেছেন!

এভাবে ইমামদের কথা তাঁদের সাহাবী ও বিশ্বস্ত রাবীদের হাতে সংরক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে সেগুলোই মহামূল্যবান হাদিস-সংকলনে পরিণত হয়েছে।

আজ আমাদের হাতে যা আছে— নাহজুল বালাগাহ, সাহিফায়ে সাজ্জাদিয়া, উসূলে কাফি, বিহারুল আনওয়ার, ইমাম সাদিক (আ.)-এর চার হাজার শিষ্যের লিখিত সনদসমৃদ্ধ বর্ণনা— এসবই আহলুলবাইতের বাণী, এসবই তাঁদের শিক্ষা, যদিও তাঁদের নিজস্ব কলমের লেখা নয়; বরং তাঁদেরই অনুমোদিত, তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধ জ্ঞান-সম্পদ।

এই একটি কৌশলের মাধ্যমে দুটি মহান উদ্দেশ্য একসঙ্গে পূর্ণ হয়েছে:

১. জ্ঞানকে চিরস্থায়ী করে লিখে রাখা হয়েছে

২. কুরআনের একক ও অপরিবর্তনীয় মর্যাদার ওপর কোনো ছায়া পড়তে দেওয়া হয়নি

এটাই ছিল আহলুল বাইতের সেই প্রজ্ঞা, যার কাছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শত্রুরাও মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha