রবিবার ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১২:১৬
ট্রাম্প সরকারের সাম্প্রতিক নথির ভিত্তিতে আমেরিকার পতনের সুস্পষ্ট লক্ষণসমূহ

আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথির প্রকাশ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, হোয়াইট হাউসের নেতাদের দম্ভোক্তির বিপরীতে বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র আর অর্থনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারছে না এবং একেবারে পতনের পথে এগোচ্ছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বহু বিশেষজ্ঞের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নথির প্রকাশ-যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান নথি এবং প্রতি চার বছর অন্তর প্রকাশিত হয়-বিশ্ব-ব্যবস্থার ওপর আমেরিকার প্রভাব কমে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য।

একটি নথির বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তিক্ত বাস্তবতা

সাংবাদিক মসউদ বারাতি এ বিষয়ে মনে করেন: নথির শুরুতেই ট্রাম্প প্রশাসন অতীতের আমেরিকান নীতিগুলোকে ভুল হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতার বাইরে ছিল।
“তারা একই সঙ্গে একটি বিশাল কল্যাণমূলক-নিয়ন্ত্রণমূলক-প্রশাসনিক রাষ্ট্রযন্ত্র এবং একটি বিশাল সামরিক, কূটনৈতিক, গোয়েন্দা কাঠামো ও বিদেশি সহায়তা-এসবের অর্থায়ন করার ক্ষেত্রে আমেরিকার সক্ষমতাকে অতিমূল্যায়ন করেছিল।”
নথিটি “মুক্ত বাণিজ্য”-এরও সমালোচনা করে এবং এটিকে আমেরিকার “মধ্যবিত্ত শ্রেণির” পতন ও “অর্থনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব” হারানোর কারণ হিসেবে তুলে ধরে। অর্থাৎ নথিটি স্বীকার করছে যে আধুনিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র আর অর্থনৈতিক বা সামরিকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব রাখে না।

তিনি আরও উল্লেখ করেন: যেসব উপাদানকে ট্রাম্পের নিরাপত্তা কৌশল নথি ভুল বলে তুলে ধরছে, সেগুলোই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকান আধিপত্য ও মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব-ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল। নথিটি স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ সীমানার ভেতরে ফিরে যেতে বলছে এবং ট্রাম্প মনে করেন আমেরিকা এতটা শক্তিশালী নয় যে পূর্বের সেই নীতিগুলো অব্যাহত রাখবে। এমনকি যখন পশ্চিম এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য) নীতি নিয়ে কথা বলে, তখনও তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন যে এই অঞ্চল আর আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না এবং “জাতি-গঠন” নামে অন্তহীন যুদ্ধগুলো শেষ হয়েছে।

শক্তির ভারসাম্য রক্ষার পদ্ধতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে

তিনি যোগ করেন: নথিটির আরেক অংশে “শিল্পশক্তি বৃদ্ধি”–কে জাতীয় অর্থনৈতিক নীতির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলা হয়েছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে আমেরিকার হারানো জাতীয় শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য মনে করে। এটি দেখায় যে ট্রাম্প বর্তমান আমেরিকান শিল্পক্ষমতাকে শান্তি বা যুদ্ধ-কোনো সময়েই দেশের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট মনে করেন না।

বারাতি আরও বলেন: নথিটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন শক্তিগুলোর উত্থানের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আগে ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র নতুন শক্তিগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে চায়—যেমন “স্বৈরাচারী অক্ষ”, “পরিবর্তনের অক্ষ” ইত্যাদি।
কিন্তু এই নথিতে জোর দেওয়া হয়েছে “শক্তির ভারসাম্য রক্ষা”-র ওপর। নথি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এমন প্রভাব বিস্তার কাউকেই করতে দিতে পারে না যাতে আমেরিকার স্বার্থ হুমকিতে পড়ে; তবে সমাধান হিসেবে বলা হচ্ছে মিত্রদের সঙ্গে মিলে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা। এটি কোনও সর্বোচ্চ মাত্রার মোকাবিলা নয়, বরং তাদের শক্তি বৃদ্ধিকে স্বীকার করে কেবল তাদের আধিপত্য ঠেকানো। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তির সমীকরণ পরিবর্তন এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে।

বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন ও পতনের ধারাবাহিকতা

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. ফুয়াদ ইযাদি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পতন নতুন কিছু নয়-বরং বহু বছর ধরেই এটি পতনের পথে রয়েছে; এমনকি মিউনিখ সম্মেলনের মতো বিশ্ব-রাজনৈতিক বৈঠকের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই বিষয়টি উঠে আসে।

তিনি বলেন: ইরানের ইসলামী বিপ্লব শুরু থেকেই পূর্ব বা পশ্চিমের আধিপত্যের বিরোধী, এবং আজও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ-যুক্তরাষ্ট্রের সত্তার কারণে নয়, বরং তার বহু দশকের অত্যাচারী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ নীতির কারণে।

শত্রুর জ্ঞান-যুদ্ধের লক্ষ্য সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে

ইযাদি বলেন: আমেরিকান নেতারা বিশেষভাবে “জ্ঞান-যুদ্ধ” পরিচালনা করছে-যাতে ইরানী জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অকার্যকর ও ভবিষ্যৎকে হতাশাজনক হিসেবে তুলে ধরা যায়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন: আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে শত্রু ও তাদের গণমাধ্যমের পরিকল্পিত প্রচারণার ফাঁদে না পড়ি এবং যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে আমাদের বিশ্লেষণ বাস্তবসম্মত ও অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে-আমেরিকার পতন তাদের নিজেদের বিশ্লেষকদের কাছেই একটি নিশ্চিত সত্য।

ভেতর থেকে ধ্বংসের গুরুতর লক্ষণ

রাজনৈতিক গবেষক ড. মোহাম্মদসাদেক খোরসান্দ বলেন: বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তা শুধু পতন নয়, বরং ভেতর থেকে ধ্বংসের লক্ষণ।
আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের সরাসরি ও পরোক্ষ সতর্কবার্তা অনুযায়ী, দেশটিতে বহু সামাজিক সংকট রয়েছে। আটলান্টিক কাউন্সিলও কিছুদিন আগে স্পষ্টভাবে বলেছিল যে সামাজিক সূচকে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।

তিনি বলেন: বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কোনও একক নেতৃত্ব নেই; বরং বহু শক্তি রয়েছে। ইতিহাস বলে, বিভিন্ন সভ্যতা ও শক্তি তাদের ক্ষমতার শিখর পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে পতনের দিকে যায়।

আমেরিকার সমাজে বিভাজন আরও তীব্র হচ্ছে

আন্তর্জাতিক বিষয়ক এই বিশ্লেষক আরও বলেন: আজকের বিশ্বব্যবস্থা আর একমেরু নয়-যা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আটলান্টিক কাউন্সিল সম্প্রতি “ব্যর্থ রাষ্ট্র” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে যে সামাজিক সমর্থন ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দেশের ভেতরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন ভবিষ্যতে আরও তীব্র হবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha