রবিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৩:৩৯
বাংলাদেশের শিয়া মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সবসময় সমান নয়। মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু অংশ হলো শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নাগরিক বাস্তবতা, নিরাপত্তা, অধিকার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতেই আমাদের এই বিশেষ সাক্ষাৎকার।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই সাক্ষাৎকারে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান (ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক) বাংলাদেশের শিয়া মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে গভীর ভাবে আলোচনা করেন, যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই আজকের এই বিশেষ আলোচনার জন্য। বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের বর্তমান সামগ্রিক অবস্থা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

উত্তরহুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আপনাকেও ধন্যবাদ জানাই।
আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশের শিয়ারা এখনো এই দেশের নাগরিক হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করছেন। তবে বাস্তবতা হলো--শিয়া মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় হওয়ায় নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিয়া মুসলমানরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত নয়, কিন্তু সামাজিক পর্যায়ে ভুল ধারণা, বিভ্রান্তি ও কখনো কখনো বিদ্বেষের মুখোমুখি হতে হয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ সবসময় সমানভাবে হয় না।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ধর্মীয় নিরাপত্তা ও ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে শিয়ারা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয় হলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিশেষ করে মুহররম, আশুরা ও শোক মজলিস। অতীতে আমরা দেখেছি কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটেছে, যা শিয়া সমাজকে মানসিকভাবে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও ভয়ের অনুভূতি পুরোপুরি দূর হয়নি। অনেক জায়গায় প্রকাশ্যে শোক মাজলিস বা ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে শিয়া মুসলমানরা সতর্কতা অবলম্বন করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে শিয়া পরিচয় কি কোনো সমস্যার কারণ হয়?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে। বিশেষ করে মিশ্র সমাজে বসবাস করার কারণে ভুল তথ্য ও অপপ্রচারের শিকার হতে হয়। অনেক সময় শিয়াদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করা হয়, যা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। তবে এটাও সত্য যে বহু সুন্নী ভাই-বোন আমাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন। সমস্যাটা মূলত অজ্ঞতা ও চরমপন্থী চিন্তা থেকে আসে, সাধারণ জনগণ থেকে নয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে শিয়া সম্প্রদায়ের অবস্থা কেমন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: শিক্ষা ও পেশাগত ক্ষেত্রে শিয়ারা মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করছেন। এখানে রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য তুলনামূলক নেই বা কম। তবে কখনো কখনো ধর্মীয় সংবেদনশীল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কেউ কেউ নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে অনাগ্রহী হন। এটি এক ধরনের নীরব মানসিক চাপ, যা সংখ্যালঘু হওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতার অংশ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিয়া তরুণ প্রজন্ম কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: তরুণদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিচয় সংকট ও বিভ্রান্তি। একদিকে তারা আধুনিক শিক্ষা ও সমাজে এগোতে চায়, অন্যদিকে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে নানা প্রশ্ন ও চাপের মুখে পড়ে। সঠিক দ্বীনী শিক্ষা, আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতনতা এবং ইতিবাচক সামাজিক সংযোগ—এই তিনটি বিষয়ে কাজ করা খুব জরুরি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান প্রত্যাশা কী?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: শিয়া মুসলমানদের প্রত্যাশা খুব মৌলিক—
১. ধর্মীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
২. ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ
৩. পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্যের সংশোধন
৪. শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমানের মাঝে পারস্পরিক সম্মান ও সহনশীলতা জোরদার করা

শিয়া মুসলমানরা আলাদা কিছু চায় না; তারা চাই ন্যায়, নিরাপত্তা ও মর্যাদা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিয়া-সুন্নি ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কী করা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: সবচেয়ে জরুরি হলো সংলাপ এবং মুক্ত ও উদার জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা।একে অপরকে তাকফীর এবং ঘৃণাত্মক ও সহিংসামূলক ভাষা ইসলাম সম্মত নয়। আলেম সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।শিয়া-সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু আকিদাগত ও ফিক্বহী পার্থক্য থাকলেও পবিত্র কুরআন, হযরত রাসূলুল্লাহর (সা.) সুন্নাহ ও সীরাত এবং মুসলিম উম্মাহর মৌলিক মূল্যবোধে শিয়া সুন্নী মুসলমানরা সবাই এক।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান: আমি আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও চরমপন্থী নয়। সঠিক দাওয়াত, শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়বিচার থাকলে শিয়া-সুন্নী সহাবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যদি জ্ঞান, নৈতিকতা ও ধৈর্য নিয়ে এগোয়—ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ ও সুন্দর হবে।

উপসংহার

এই সাক্ষাৎকার থেকে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের শিয়া মুসলমান সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী হলেও বাস্তবে তাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। নিরাপত্তা, সচেতনতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha