মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১২:১৫
রজব মাস; আল্লাহর রহমতের দুয়ার এবং মানুষের আত্মিক সাধনার সূচনা

রজব মাস হলো আল্লাহর অবারিত রহমত বর্ষণের মাস এবং গুনাহের কলুষতা থেকে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার এক অনন্য সুযোগ। এই মাস মানুষকে গাফিলতির ধূলি থেকে জাগিয়ে তোলে, যাতে তাওবা, দোয়া ও রোজার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যের পথে অগ্রসর হয়ে শা‘বান ও রমজানের মহান আতিথেয়তার জন্য নিজের আত্মাকে প্রস্তুত করতে পারে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা রজব মাসকে “শাহরুল্লাহিল আসাব্ব—রহমত বর্ষণের মাস” নামে অভিহিত করেছেন। এই মাস কেবল ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ সময় নয়; বরং এটি এমন এক প্রবেশদ্বার, যা আমাদের শা‘বান ও রমজানের মহান ঐশী আতিথেয়তার দিকে পথ দেখায়। রজব মাস হলো ফেরেশতাদের ফিসফিস ধ্বনি, যা গাফেল আত্মার কানে পৌঁছে যায়; এটি সেইসব মানুষের জন্য এক জাগরণ, যাদের দেহ দুনিয়ায় আবদ্ধ এবং আত্মা গাফিলতিতে নিমজ্জিত।

রজব এমন এক সুযোগ, যা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন যেন সে নিজেকে গুনাহের মরিচা থেকে মুক্ত করে হালকা হয়ে উঠতে পারে। এই মাস মানুষের আত্মার তৃষ্ণার্ত মরুভূমির মতো, যা ঐশী রহমতের অবতরণে চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত হয়। যদি কেউ এই মাসে গাফিল থাকে, তবে সে এমন এক কৃষকের মতো, যে উর্বর জমি ফেলে রেখে রমজান মাসে ফসল পাওয়ার আশা করে।

রজব মাস হলো মানুষের এক বছরের আত্মিক সফরের প্রথম স্টেশন। এই আত্মিক সফর এমন এক পথ, যেখানে মানুষ তার বস্তুগত সত্তা থেকে নিজের প্রকৃত অস্তিত্বের দিকে অগ্রসর হয়। এই অগ্রযাত্রার জন্য প্রাথমিক পরিশুদ্ধি অপরিহার্য। যেমন—উড্ডয়নের আগে একটি বিমানকে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তেমনি আমাদের আত্মাকেও রজব মাসে কলুষতা থেকে মুক্ত হতে হবে, যাতে শা‘বানে তা অলংকৃত হতে পারে এবং রমজানে চূড়ান্ত মিলনের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী অনুযায়ী—রজব হলো ক্ষমার মাস, শা‘বান হলো দরুদ ও দোয়ার মাস এবং রমজান হলো কুরআন ও রোজার মাস। এই প্রজ্ঞাপূর্ণ বিভাজন প্রমাণ করে যে প্রতিটি মাসের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে এবং রজব মাস আমাদের কাঁধে অতীতের পাপের প্রভাব মুছে ফেলার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে।

“শাহরুল্লাহিল আসাব্ব”—রহমত বর্ষণের মাস—এর প্রকৃত অর্থ হলো, এই মাসে আল্লাহ তাআলা অন্যান্য মাসের তুলনায় আরও উদারভাবে তাঁর রহমত ও মাগফিরাতের দরজা খুলে দেন। এই রহমত বর্ষণ সেই বৃষ্টির মতো, যা মরুভূমির ওপর ঝরে পড়ে। কিন্তু যদি মানুষের হৃদয় ও আত্মার পাত্র ইস্তিগফার ও তাওবার মাধ্যমে প্রস্তুত না থাকে, তবে এই রহমতের বৃষ্টি কোনো প্রভাব ফেলবে না এবং মানুষের পাশ দিয়েই বয়ে যাবে। এই প্রস্তুতির অর্থ হলো—দুনিয়াবি আসক্তি ত্যাগ করা এবং নৈতিক দায়িত্বের ভার গ্রহণ করা।

রজব মাস হলো আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের (আসমাউল হুসনা) এক উজ্জ্বল প্রকাশ। এই মাসে মানুষ তিনটি মূল্যবান রত্নের মুখোমুখি হয়—
ইস্তিগফার ও গভীর তাওবা,
দোয়া ও মুনাজাত (অন্তরের ভাষার জাগরণ) এবং
রোজা (দেহের ওপর আত্মার কর্তৃত্ব অনুশীলন)।
এর প্রতিটিই একজন মুমিনের চরিত্র গঠনের জন্য একটি করে স্তম্ভ।

রজব মাসে ইস্তিগফার কেবল “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ সাহসের সঙ্গে নিজের গুনাহের ভয়াবহতা এবং নিজের প্রতিপালকের মহানত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর ফিরে যাবে না। রজবের তাওবা হলো গভীর ও হৃদয়গ্রাহী তাওবা। যদি কারও ইস্তিগফার কেবল মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু বাস্তব জীবনে কোনো পরিবর্তন না আসে, তবে তা এমন যেন নোংরা ঘরের কেবল বাইরের অংশ পরিষ্কার করা হয়েছে, অথচ দুর্গন্ধ রয়ে গেছে।

রজবিয়ার দোয়া হলো এই মাসের মারেফতের সারাংশ। এতে বলা হয়েছে—
“হে আমার প্রতিপালক! তোমার আহ্বানের মাধ্যমে আমাকে তোমার সম্মান দান করো এবং তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে আমাকে তোমার অনুগ্রহ আরও বৃদ্ধি করে দাও।”
এটি প্রমাণ করে যে দোয়া নিজেই কৃতজ্ঞতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রূপ এবং নিয়ামত বৃদ্ধির কারণ।

এই মাসের নফল রোজা হলো দেহের ওপর আত্মার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অনুশীলন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যে প্রতিটি লোকমা মুখে তোলে না, তা নফসের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ঘোষণা। বাস্তবে এই রোজার একটি সহজ প্রশিখনমূলক সূত্র রয়েছে—যদি মানুষ দিনের বেলায় একটি স্বাভাবিক ও হালাল প্রয়োজন (খাবার ও পানীয়) নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে সে সারা বছর শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রলোভনের বিরুদ্ধেও সহজেই সংযম অবলম্বন করতে পারবে। এই আত্মসংযমের অনুশীলন একটি অত্যন্ত কার্যকর জীবনদক্ষতা।

রিপোর্ট: হাসান রেজা 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha