হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.) এমন এক মহান নবী, যাঁর জন্ম, জীবন ও রিসালাতের প্রথম অধ্যায় অলৌকিক নিদর্শন ও ঐশী ঘটনায় পরিপূর্ণ। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পিতা ছাড়াই তাঁর সৃষ্টি হযরত আদম (আ.)–এর সৃষ্টির ন্যায়, যা আল্লাহর “কুন” (হও) আদেশের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
এই অলৌকিক সূচনা ছিল তৎকালীন বস্তুবাদী মানসিকতার প্রতি এক সুস্পষ্ট বার্তা— এই যে, বস্তুজগত কোনো স্বাধীন শক্তি নয়; বরং তা সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণের অধীন। পবিত্রা মারিয়াম ((সা.আ.)), যিনি নিজেই তাঁর যুগের নির্বাচিত ও শ্রেষ্ঠ নারীদের অন্যতম ছিলেন, এই ঐশী আমানত ধারণের মাধ্যমে এমন এক নবীর আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন, যিনি দোলনা থেকেই আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করেন।
হযরত ঈসা (আ.)–এর পার্থিব জীবনের সীরাত ছিল ইতিবাচক জুহদ ও নৈতিক সাধনার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যখন কিছু ইহুদি ধর্মীয় নেতার মধ্যে বিলাসিতা ও ক্ষমতার মোহ বিস্তার লাভ করেছিল, তখন ঈসা (আ.) রুক্ষ পোশাক পরিধান করে এবং বিলাসবিহীন জীবনযাপন করে পাহাড় ও মরুভূমিতে মানুষের হেদায়েতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি শুধু বাহ্যিকভাবে সরল জীবনযাপন করতেন না, বরং অন্তর থেকেও দুনিয়ার প্রতি সামান্যতম আসক্তি রাখতেন না।
বর্ণনায় এসেছে, তিনি শুকনো রুটি আহার করতেন, বৃষ্টির পানি পান করতেন এবং পাথরকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই জীবনধারা ছিল তাঁর যুগের সম্পদপূজা ও ভোগবাদী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ এবং মানুষকে আসমানী রাজ্যের দিকে আহ্বানের এক স্থায়ী বার্তা।
মৃতদের জীবিত করা, জন্মান্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়াসহ তাঁর মু‘জিযাগুলো ছিল মূলত রহমত, আরোগ্য ও জীবনীশক্তির প্রতীক। এসব মু‘জিযা কেবল অলৌকিক ক্ষমতার প্রদর্শন ছিল না; বরং মৃতপ্রায় আত্মাকে পুনর্জীবিত করা এবং সত্যদর্শী চোখকে আলোকিত করার এক গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করত।
হযরত ঈসা (আ.) তাঁর দাওয়াতি পদ্ধতিতে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও করুণার সঙ্গে বাতিলের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানকে একত্র করেছিলেন। তিনি তাওরাতকে সত্যায়ন করার পাশাপাশি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে সেই কঠোর বিধিনিষেধগুলো রহিত করেন, যা ইহুদিরা নিজেদের ওপর অযথা চাপিয়ে নিয়েছিল। এর মাধ্যমে তিনি সহজ, মানবিক ও সহনশীল নববী শরিয়তের পথ উন্মুক্ত করেন।
তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিশন ছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান। তিনি ছিলেন সেই অগ্রদূত, যিনি মানবসমাজকে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত দ্বীনের গ্রহণের জন্য মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রস্তুত করে যান। তাঁর পার্থিব জীবনের এই অধ্যায় শেষ হয় এক অলৌকিক উর্ধ্বারোহণের মাধ্যমে।
খ্রিস্টধর্মে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে এবং মানবজাতির পাপ মোচনের জন্য তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে— কিন্তু পবিত্র কুরআন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, আল্লাহ তাঁকে শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন এবং নিজের কাছে তুলে নেন। এটি তাঁর মিশনের সমাপ্তি নয়; বরং এক অস্থায়ী স্থগিতাবস্থা, কারণ আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল— তিনি শেষ যুগে আল্লাহর শেষ হুজ্জাত ইমাম মাহদী (আ.ফা.)–এর পাশে দাঁড়িয়ে পৃথিবীতে ন্যায় ও ইনসাফের অসমাপ্ত প্রকল্প পূর্ণতা দেবেন।
হযরত ঈসা (আ.)–এর পুনরাগমন: বিশ্বশান্তি ও ধর্মীয় ঐক্যের চাবিকাঠি
হযরত ঈসা (আ.)–এর রিসালাতের দ্বিতীয় ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হবে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)–এর আবির্ভাবের সঙ্গে। ইসলামী মাহদীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, ঈসা (আ.)–এর পুনরাগমন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং বিশ্বব্যাপী ন্যায়, শান্তি ও ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক কৌশলগত ও ঐশী প্রয়োজন।
বিশ্বের কোটি কোটি খ্রিস্টানের কাছে হযরত ঈসা (আ.)–এর মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা মাহদী আন্দোলনের পথে সবচেয়ে বড় মানসিক ও ধর্মীয় বাধা দূর করে দেয়। যখন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করে সমগ্র বিশ্বের সামনে ইমাম মাহদী (আ.)–এর পেছনে নামাজ আদায় করবেন, তখন এই এক ঘটনাই মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিপ্লবের সূচনা করবে।
এই নামাজ তাওহীদের সার্বজনীন ঐক্যকে দৃশ্যমান রূপ দেবে এবং খ্রিস্টানদের কাছে সুস্পষ্ট করে তুলবে যে সকল ঐশী ধর্মের প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতা হলেন ইমাম মাহদী (আ.ফা.), আর ঈসা (আ.) তাঁর সহকারী ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই ঐতিহাসিক আনুগত্য যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই লক্ষ লক্ষ হৃদয়কে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং ধর্মীয় বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বৈশ্বিক আধিপত্যবাদী শক্তিকে ভেঙে দেবে।
আবির্ভাবের যুগে হযরত ঈসা (আ.)–এর ভূমিকা হবে বহুমাত্রিক। তিনি ধর্মীয় বিকৃতি ও বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি সংশোধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। হাদিসে বর্ণিত “ক্রুশ ভাঙা” প্রতীকীভাবে বিকৃত ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস ও ঈসা (আ.)–এর উপাসনার অবসান নির্দেশ করে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করবেন— তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
মাহদাভী রাষ্ট্রে হযরত ঈসা (আ.) বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। বিচারকার্য ও মুসলিমদের কোষাগার তত্ত্বাবধানের মতো গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করা ইমাম মাহদী (আ.ফা.)–এর পূর্ণ আস্থা ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ।
শেষ যুগের নির্ণায়ক সংঘর্ষগুলোতে— বিশেষ করে দাজ্জালের ফিতনার বিরুদ্ধে— হযরত ঈসা (আ.) কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবেন। দাজ্জাল, যে প্রতারণা, বস্তুবাদ ও ভ্রান্ত মোহের প্রতীক, ফিলিস্তিনের “লুদ” অঞ্চলে হযরত ঈসা (আ.)–এর হাতে নিহত হবে। এই ঘটনা পৃথিবীতে শয়তানি আধিপত্যের চূড়ান্ত অবসান নির্দেশ করবে।
ফিতনা ও অশান্তির অবসানের পর, ইমাম মাহদী (আ.ফা.) ও তাঁর সহযোগী হযরত ঈসা (আ.)–এর যৌথ নেতৃত্বে পৃথিবী ন্যায়, নিরাপত্তা ও বরকতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে—সে যুগে নেকড়ে ও মেষ একসঙ্গে চরবে, মানুষের হৃদয় থেকে বিদ্বেষ ও হিংসা সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যাবে।
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)–এর পাশে হযরত ঈসা (আ.)–এর উপস্থিতি এই সত্যকে স্পষ্ট করে যে মানবতার চূড়ান্ত আদর্শ সমাজ গঠনে সকল নবীর প্রচেষ্টা পরস্পর সংযুক্ত। হযরত ঈসা (আ.), নবুয়তের মহান উত্তরাধিকারী হিসেবে, শেষ ওয়ালির নেতৃত্বে সমগ্র পৃথিবীতে তাওহীদের পতাকা উড্ডীন করবেন।
আপনার কমেন্ট