হাওজা নিউজ এজেন্সি: হাওজায়ে ইলমিয়ার প্রখ্যাত শিক্ষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাদিক ইব্রাহিমী সারিতে হাওজা নিউজের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে ইসলাম ধর্মে বেলায়াত ও ইমামতের উচ্চ মর্যাদা ও মৌলিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের আহলে সুন্নাত ভাইয়েরা সাধারণত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পর নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গকে একটি গৌণ ফেকহি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন। অথচ আমরা শিয়ারা এটিকে আমাদের মাযহাবের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে দেখি। বরং সত্য বলতে গেলে, ইসলামের সমস্ত স্তম্ভ ও বিধান এই ওলায়াতের কেন্দ্রবিন্দুর চারপাশেই স্থিত।”
গাদীর খুম—উম্মতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী ঐতিহাসিক ঘোষণা
তিনি গাদীর খুমের ঐতিহাসিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “গাদীর খুমের সেই স্মরণীয় দিনে, অসংখ্য সাহাবির উপস্থিতিতে, নবী করিম (সা.) আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্যভাবে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর প্রশ্নাতীত বেলায়াত ও নেতৃত্ব ঘোষণা করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমি যার মাওলা, আলী তারই মাওলা।’
এই ঘোষণা কোনো সাধারণ বক্তব্য ছিল না; বরং এটি ছিল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এক চূড়ান্ত নির্দেশ, যা উম্মতের ভবিষ্যৎ পথ ও নেতৃত্বের দিক নির্ধারণ করে দেয়।”
শুধু ভালোবাসার উপদেশ—এই ব্যাখ্যা বাস্তবতাবিরোধী
হাওজার শিক্ষক আরও বলেন, “কোনোভাবেই এটা যুক্তিসংগত নয় যে প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে, পথের মধ্যবর্তী এক স্থানে, হাজার হাজার মানুষকে থামিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) কেবল আলী (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের একটি নৈতিক উপদেশ দিতে চেয়েছিলেন। এ ধরনের ব্যাখ্যা গাদীরের বাস্তবতা, পরিবেশ ও গুরুত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।”
তিনি আরও যোগ করেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতোমধ্যেই নামাজ, রোজা, হজসহ ইসলামের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিধান বহু বছর ধরে প্রচার করে এসেছেন। সুতরাং এখানে যে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে এসব বিধানের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক।”
কুরআনের সুস্পষ্ট ও কঠোর নির্দেশ
হুজ্জাতুল ইসলাম ইব্রাহিমী কুরআন মাজিদের এই আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেন, ‘فَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ “যদি তুমি এটি (বেলায়াতের ঘোষণা) না কর, তবে তুমি তোমার রিসালাতই পৌঁছালে না।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই আয়াত প্রমাণ করে যে বেলায়াতের ঘোষণা আল্লাহর দৃষ্টিতে কতটা মৌলিক ও কেন্দ্রীয় বিষয়। কুরআনে অন্য কোনো বিধান সম্পর্কে এমন কঠোর ভাষা ব্যবহৃত হয়নি যে, তা পালন না করলে সম্পূর্ণ রিসালাতই অপ্রচারিত থেকে যাবে।”
বেলায়াত—ইসলামের স্থায়িত্ব ও হেদায়াতের নিশ্চয়তা
তিনি বলেন, “বেলায়াত হচ্ছে ঐশী শাসনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ এবং নবুওয়াতের পর হেদায়াতের ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা। রাসূলুল্লাহ (সা.) পূর্বে একাধিকবার আলী (আ.)-এর মর্যাদা ও অবস্থান তুলে ধরলেও, গাদীর খুমে এই ঘোষণার মাধ্যমে উম্মতের ওপর চূড়ান্ত দলিল প্রতিষ্ঠা করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এর আগে নবী করিম (সা.) মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অতএব গাদীরের মতো একটি ঐতিহাসিক ও সংকটপূর্ণ প্রেক্ষাপটে কেবল বন্ধুত্বের কথা বলার ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তবতা হলো—কিছু ইতিহাসবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক গাদীরের এই সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্য ও তার গভীর তাৎপর্য স্বীকার করতে অনিচ্ছুক।”
ইমাম মাহদী (আ.) পর্যন্ত বেলায়াতের অবিচ্ছিন্ন ধারা
হুজ্জাতুল ইসলাম ইব্রাহিমী বলেন “গাদীরের খুতবার কিছু প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায়, নবী করিম (সা.) কেবল হযরত আলী (আ.) নয়, বরং ইমাম মাহদী (আ.) পর্যন্ত বেলায়াতের ধারাবাহিকতার কথাও উল্লেখ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে ঐশী হেদায়াত একটি অবিচ্ছিন্ন ও সুসংযুক্ত শৃঙ্খল।”
বারো জন উত্তরাধিকারী—আহলে বাইতের বারো ইমাম
তিনি আরও বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত বহু হাদিসে এসেছে যে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারীর সংখ্যা হবে বারো জন যেমন হযরত মূসা (আ.)-এর বারো জন নকিব ছিলেন। আমরা শিয়ারা বিশ্বাস করি, এই বারো জনই হলেন আহলে বাইতের বারো ইমাম (আ.)—যাঁরা তাকওয়া, জুহদ, জ্ঞান, শাসনক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও নিষ্পাপত্বে নবী করিম (সা.)-এর পথের প্রকৃত উত্তরাধিকারী।”
আলী (আ.)—জ্ঞান ও নেতৃত্বের একমাত্র যোগ্য ব্যক্তিত্ব
শেষে তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে একমাত্র এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত আলী (আ.), যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন
‘আমাকে প্রশ্ন করো, আমাকে হারানোর আগেই।’
অন্যদিকে ইতিহাসে দেখা যায়, অনেকেই নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন কিংবা আলী (আ.)-এর জ্ঞানের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান পেয়েছেন। এর একটি প্রসিদ্ধ উদাহরণ হলো, ‘আলী না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।’”
আপনার কমেন্ট