হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিখ্যাত বাণী, তিনি বলেন:
"إِنِّي لَمْ أَخْرُجْ أَشِرًا وَلَا بَطِرًا وَلَا مُفْسِدًا وَلَا ظَالِمًا، وَإِنَّمَا خَرَجْتُ لِطَلَبِ الْإِصْلَاحِ فِي أُمَّةِ جَدِّي مُحَمَّدٍ (ص). أُرِيدُ أَنْ آمُرَ بِالْمَعْرُوفِ وَأَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ، وَأَسِيرَ بِسِيرَةِ جَدِّي وَأَبِي عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ."
"আমি অহংকার করে, গর্ব করে, ফিতনা সৃষ্টি করতে, কিংবা জুলুম করার জন্য বার হইনি। আমি কেবল আমার নানা মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের সংশোধনের জন্য বার হয়েছি। আমি চেয়েছি সৎ কাজের আদেশ দিতে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে এবং আমার নানা মুহাম্মদ (সা.) ও আমার পিতা আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর পথ অনুসরণ করতে।"
এই বাণী ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে তুলে ধরে। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তার সংগ্রামের লক্ষ্য ক্ষমতা দখল বা বিদ্রোহ নয়, বরং উম্মতের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ।
ইসলামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মদিনা ত্যাগ। ২৮ রজব ৬০ হিজরিতে ইমাম হুসাইন (আ.) মদিনা ত্যাগ করেন। এটি শুধু একটি ভ্রমণ নয়; বরং এক মহৎ আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের সূচনা। এখানে আমরা সংক্ষেপে সেই পটভূমি ও কারণগুলো তুলে ধরব-- যা ইমাম হুসাইন (আ.)-কে মদিনা ত্যাগে বাধ্য করেছিল।
পটভূমি:
৫৬ হিজরিতে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান মৃত্যুবরণ করে এবং তার পুত্র ইয়াজিদ খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইয়াজিদ একজন অত্যন্ত অধার্মিক, অত্যাচারী এবং ইসলামবিরোধী ব্যক্তি ছিল। তার কার্যকলাপ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছিল।
মুয়াবিয়া তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও চুক্তির মাধ্যমে ইয়াজিদকে খলিফা মনোনীত করে যায়। যদিও এই পদক্ষেপ ইসলামের প্রকৃত খিলাফতের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ইয়াজিদ ক্ষমতায় আসার পর, তার প্রথম কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ব্যক্তিত্বদের থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা। তার লক্ষ্য ছিল যে, ইসলামের কেন্দ্রীয় ও সৎ ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে আনুগত্য নিশ্চিত করা, যাতে তার অন্যায় শাসন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অবস্থান:
ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৌহিত্র এবং ইসলামের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী। তার জীবন ছিল সত্য, ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর আনুগত্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি কখনোই একজন অত্যাচারী ও পাপিষ্ঠ শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে পারেন না। ইয়াজিদ তার কাছে আনুগত্যের শপথ দাবি করলে, ইমাম তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন:
"ইয়াজিদের মতো একজন ব্যক্তি কখনোই হুসাইনের মতো ব্যক্তির আনুগত্য পাওয়ার যোগ্য নয়।"
ইমামের এই অবস্থান ছিল কেবল তার ব্যক্তিগত নীতির জন্য নয়; বরং সমগ্র উম্মাহকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার জন্য।
মদিনা ত্যাগের কারণ:
ইমাম হুসাইন (আ.) মদিনায় অবস্থানকালে ইয়াজিদের পক্ষ থেকে তাঁকে শপথ নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। মদিনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উতবা ইয়াজিদের নির্দেশে ইমামের কাছে আনুগত্যের দাবি করে। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, ইয়াজিদ শুধু তাকে হত্যা করতে চায় না; বরং ইসলামের প্রকৃত চেতনা ও মূল্যবোধকেও ধ্বংস করতে চায়।
ইমাম যদি মদিনায় থাকতেন, তাহলে ইয়াজিদের বাহিনী সেখানে তাঁর ওপর আক্রমণ করত, যাতে মদিনার পবিত্রতা লঙ্ঘিত হয় এবং সাধারণ জনগণের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ত। এ কারণে তিনি মদিনা ত্যাগ করে এমন একটি স্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে তিনি নিজের অবস্থানকে উম্মাহর সামনে আরও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন।
ইমামের মদিনা ত্যাগ:
২৮ রজব ৬০ হিজরিতে ইমাম হুসাইন (আ.) তার পরিবার ও কিছু সঙ্গীকে নিয়ে মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদিনা ত্যাগ করার আগে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারকে যান এবং সেখানে অনেকক্ষণ অবস্থান করেন। ইমামের হৃদয় তখন ভারাক্রান্ত ছিল, কারণ তিনি জানতেন যে, এটাই তার প্রিয় শহর মদিনার সঙ্গে শেষ বিদায়।
ইমাম মক্কা গিয়ে কিছু সময় অবস্থান করেন এবং উম্মাহকে ইয়াজিদের অত্যাচার ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু ইয়াজিদ মক্কাতেও তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল, যা ইমামকে কুফার দিকে যাত্রা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এই যাত্রায় শেষ পর্যন্ত কারবালার ময়দানে অসাধারণ আত্মত্যাগ ও ইসলামের বিজয়ের ইতিহাস রচনা করে।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মদিনা ত্যাগের শিক্ষা:
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মদিনা ত্যাগের ঘটনাটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য কখনোই অন্যায়ের সাথে আপস করা উচিত নয়। যদি পরিস্থিতি অন্যায়ের পক্ষে চলে যায়, তাহলে তা রুখে দাঁড়ানোর জন্য সাহসিকতা ও ত্যাগের মনোভাব থাকা জরুরি। ইমামের এই ত্যাগ ছিল কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; বরং তা সর্বদা মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিখ্যাত বাণী, যা তিনি কারবালার ময়দানে বলেছিলেন;তা হলো:
"إِنْ كَانَ دِينُ مُحَمَّدٍ لَا يَسْتَقِيمُ إِلَّا بِقَتْلِي، فَيَا سُيُوفُ خُذِينِي"
"যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর দ্বীন (ইসলাম) আমার হত্যার মাধ্যম ছাড়া টিকে থাকতে না পারে, তবে হে তরবারি! আমাকে এসে আঘাত করো।"
এই বাণীর মাধ্যমে ইমাম হুসাইন (আ.) স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ইসলামের সত্যতা ও মূল আদর্শ রক্ষার জন্য তিনি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। এটি শুধু একটি আত্মত্যাগ নয়; বরং ইসলামের ন্যায়, সত্য ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য এক চিরন্তন শিক্ষার প্রতীক।
শেষ কথা:
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মদিনা ত্যাগ ছিল ইসলামের প্রকৃত চেতনা রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তার এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়; এটি একটি আদর্শ, যা ন্যায়, সত্য এবং মানবতার জন্য প্রতিষ্ঠিত।
السلام عليك يا إمام الحسين(ع)
হে ইমাম হুসাইন, আপনার প্রতি আমাদের সালাম।
লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মি।
তারিখ: ২৮/০১/২০২৫
আপনার কমেন্ট