হাওজা নিউজ এজেন্সি: পর্ব ৩-
কারবালা:
বুধবার, ৮ই মহরম, ৬১ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) এবং হজরত আব্বাস (আ.) এজিদী সৈন্যদের প্রাচীর ভেদ করে ফুরাত নদী থেকে মশকে পানি ভরে তাবুতে নিয়ে আসে।
ইমাম হুসাইন (আ.) ওমরে সাআদ এর সাথে সাক্ষাত করে এবং তাকে বলেনঃ হে সাআদের সন্তান! তুমি কি খোদা কে ভয় পাও না?
ওমর সাআদ বলে, আমি যদি এ দল থেকে সরে যাই তাহলে তারা আমার ঘরকে ধ্বংস করে দিবে এবং আমার সমস্ত সম্পদকে কেড়ে নিবে আমি আমার পরিবারের জন্য ইবনে যিয়াদকে ভয় পাই।
ইমাম (আ.) তাকে বলেন, তুমি কি মনে কর আমাদেরকে হত্যা করে তুমি “রেই” নামক স্থানের হুকুমত অর্জন করবে? খোদার শপথ তুমি কখনই তার স্বাদ ভোগ করতে পারবে না।
তারপর ইমাম (আ.) তার সঙ্গিদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, তোমরা ধৈর্য ধারণ কর বেহেস্ত তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
কারবালা:
বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মহরম, ৬১ হিজরীতে শিমর ইমাম হুসাইন (আ.) এর তাবুর কাছে আসে এবং হযরত আব্বাস এবং উম্মুল বানিনের অন্যান্য সন্তানদের উদ্দেশ্যে করে চিৎকার দিয়ে বলে, আমি তোমাদের জন্য উবাইদুল্লাহর কাছ থেকে নিরাপত্তার চিঠি নিয়ে এসেছি। জাবাবে তারা বলেন, তোমার এবং তোমার নিরাপত্তা দানের চিঠির উপরে আল্লাহর লানত হোক, এটা কিভাবে সম্ভব যে আমরা নিরাপত্তার মধ্যে থাকব আর রাসুল (সা.) এর নাতী এবং হযরত ফাতেমা (আ.) এর সন্তান নিরাপত্তা পাবে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুদের কাছ থেকে এক রাত সময় চান যেন সেই রাতে মন ভরে খোদার ইবাদত এবং কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন।
ইমাম তাবুর চারিদিকে পরিখা খনন করেন এবং তার আশেপাশে তাঁর সাহাবীদের মোতায়েন করেন যেন শত্রুরা কোনমতে তাবুর কাছে আসতে না পারে।
যাতে ইরাক্ব:
১৪ই জিলহজ্ব সোমবার ৬০ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) সেখানে পৌছান। উক্ত স্থানে হজরত জয়নাব এর স্বামী মদীনার গভর্ণর আমরু বিন সাঈদের কাছ থেকে নিরাপত্তা দানের সত্যায়িত চিঠি নিয়ে আসে এবং ইমাম হুসাইন (আ.)’কে কুফার দিকে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) আমরু বিন সাঈদের চিঠির জাববে লিখেন যে, মুসলমান হচ্ছে তারা যারা খোদার পথে দাওয়াত দেয় এবং সৎকর্ম করে এবং খোদা রাসুল (সা.) কখনও পৃথক হয় না। যেহেতু তুমি আমাকে নিরাপত্তা দিবে বলেছ সেহেতু খোদা যেন তোমাকে এর সওয়াব দান করেন।
আব্দুল্লাহ তার দুই সন্তানকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য ইমাম হুসাইন (আ.)’কে আবেদন জানায় এবং মক্কার দিকে ফিরে যায়।
ইমাম হুসাইন (আ.) এখানে আমরু বিন সাঈদকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল খোদার নিরাপত্তা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম। আমরা যেন এ দুনিয়াতে তাকে ভয় করি যেন আখেরাতের নিরাপত্তা অর্জন করতে পারি।
হাজের:
মঙ্গলবার, ১৫ই জিলহজ্ব, ৬০ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) হাজের নামক স্থানে পৌছান। তিনি সেখান থেকে “কাইস বিন মুসহের” এর মাধ্যমে কুফাবাসীদের উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করেন। তিনি চিঠিতে লিখেন যে মুসলিমকে তোমাদের সাহায্যে সহযোগিতার কথা আমি শুনেছি খোদা তোমাদেরকে উক্ত কাজের জন্য উত্তম প্রতিদান দান করবেন। যখন মুসহের তোমাদের কাছে পৌছাবে তখন তোমরা তার কাজে সাহায্যে করো। আমিও কিছু দিনের মধ্যে তোমাদের মাঝে পৌছে যাব।
কিন্তু কাইসকে পথিমধ্যে বন্দি করা হয়। তখন সে বাধ্য হয়ে ইমাম হুসাইন (আ.) এর চিঠিটি ছিড়ে ফেলে যেন কেউ তা সম্পর্কে অবগত না হতে পারে। তারপরে তাকে বন্দি অবস্থায় কুফার দারুল আমারতে উবাইদুল্লাহ এর কাছে উপস্থিত করা হয়। তাকে বলা হয় যে সকল ব্যাক্তিরা ইমাম হুসাইন (আ.)’কে চিঠি লিখে দাওয়াত করেছিল তিনি যেন তাদের নামগুলো বলে দেয় অথবা জনসম্মুখে ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তার ভাই এবং পিতাকে গালমন্দ করে। তখন তিনি দারুল আমারার ছাদের উপরে যেয়ে হজরত আলী (আ.) এবং তার সন্তানদের প্রসংশা শুরু করেন এবং ইবনে যিয়াদ এবং তার সঙ্গীসাথীদেরকে তিরষ্কার করে এবং ইমাম হুসাইন (আ.) এর কুফাতে আগমনের খবর দেয় এবং জনগণকে তাঁর সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। তখন উবাইদুল্লাহ নির্দেশে তাকে ছাদের উপর থেকে ফেলে দেয়া হয় এবং তার শরীরকে টুকরা টুকরা করে দেয়া হয় এবং এভাবে তিনি শাহাদত বরণ করেন।
খুযাইমিয়াহ:
শুক্রবার, ১৮ই জিলহজ্ব, ৬০ হিজরীতে তিনি খুযাইমিয়াহ নামক স্থানে পৌছান। ইমাম হুসাইন (আ.) সেখানে একদিন এবং এক রাত অতিবাহিত করেন। কিছু লোক তার সে আধ্যাত্মিক সফরে যোগ দেয়। যোহর বিন কাইন ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।
ইমাম হুসাইন (আ.) এখানে তার বোন হজরত জয়নাব কে বলেনঃ হে আমার বোন! খোদা আমাদের জন্য যা ঠিক করে রেখেছেন তাই ঘটবে।
যারুদ:
সোমবার, ২১শে জিলহজ্ব, ৬০ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) যারুদ নামক স্থানে পৌছান। যোহাইর বিন ক্বাইন যে ছিল উসমানী চিন্তাধারী ব্যক্তি যে উক্ত বছরে মক্কা থেকে হজ্ব সম্পাদনের পরে কুফার দিকে ফিরে যাচ্ছিল। যদিও প্রথমে সে ইমাম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করতে চাইনি কিন্তু ঘটনাক্রমে উক্ত স্থানে ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথে তার সাক্ষাত হয়ে যায়। যখন যোহর তার লোকজনদের সাথে খাবার খাচ্ছিল তখন ইমাম হুসাইন (আ.) তার বার্তা বাহকের মাধ্যমে যোহাইর কে ডেকে পাঠায় তখন সে একটু চিন্তা করে। তার স্ত্রী বলে, সুবহান আল্লাহ তোমার কত সৌভাগ্য যে রাসুল (সা.) এর নাতী তোমাকে দাওয়াত দিয়েছে আর তুমি তার কবুল করবে না।
যোহাইর এর শাহাদাতের পরে ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন, হে যোহাইর! খোদা নিজের দয়া রহমত তোমার চারিদিকে দান করেছেন এবং তোমার হত্যাকারীকে অভিশপ্ত করা হয়েছে।
সাআলাবিইয়া:
মঙ্গলবার, ২২ জিলজৃহজ্ব, ৬০ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) সাআলাবিইয়াতে পৌছান। ইমাম (আ.) রাতে উক্ত স্থানে পৌছান এবং এখানেই তাঁকে মুসলিম বিন আক্বিল এবং হানী বিন উরওয়ার শাহাদতের খবর তিনি শুনতে পান। তখন ইমাম (আ.) বলেন, (اِنّا لِلّه وَ اِنّا اِلَيهِ راجِعون) হয়তো এরা (কুফাবাসীরা) আমার কোন উপকারেই আসবে না। এই বলে তিনি ক্রন্দন শুরু করেন এবং তাঁর সফরসঙ্গীরাও তার সাথে কাঁদতে শুরু করে।
ইতিহাসে বলা হয়েছে যে ইমাম (আ.) তার সফরসঙ্গীদের কাছে নিজের হুজ্জাত সম্পূর্ণ করেন এবং যারা পার্থিব সম্পদের জন্য এসেছিল তারা উক্ত খবরটি শুনারর সাথে সাথে ইমাম (আ.) কে ছেড়ে চলে যায়।
যোবালে:
বুধবার, ২৩ জিলহজ্ব, ৬০ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) যোবালে নামক স্থানে পৌছান। ইমাম (আ.) উক্ত স্থানে বলেন, কুফাবাসীরা আমার সাথে তাদের কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেছে এবং আমাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ফিরে যেতে চায় তাহলে সে ফিরে যেতে পারে এবং আমি আর তার জীবনের দ্বায়িত্বভার নিতে পারব না।
ওমরে সাআদের সৈন্য বাহিনী থেকে কিছু লোক ইমাম (আ.) এর সাথে যোগ দেয়।
ইমাম (আ.) শত্রুদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, তোমাদের জন্য আমার মায়া হয় যে আমার সাহায্যের আবেদন শুনার পরে তোমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে যা তোমরা বুঝতে পারছ না। আমি তোমাদেরকে সীরাতে মুসতাকিমের পথে আহবান জানাচ্ছি কিন্তু তারপরেও তোমরা আমার কথায় কর্ণপাত করছ না। কেননা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং তোমাদের অন্তরে মোহর লেগে গেছে।
কারবালা:
শুক্রবার, ১০ই মহরম ৬১ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (আ.) তার সাহাবীদের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং তাদেরকে বলেন, আমার এবং তোমাদের শাহাদতের মধ্যে খোর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে। সুতরাং তোমরা ধৈর্য ধারণ করো।
ইমাম বাহিনীর ডান দিকের সৈন্য বাহিনীর প্রধান ছিলেন যোহাইর বিন কাইন, বাম দিকের সৈন্য বাহিনীর প্রধান ছিলেন হাবীব ইবনে মাযাহির এবং পতাকাবাহি ছিলেন হযরত আব্বাস (আ.)। যদিও এজিদি সৈন্য কাহিনী ইমাম (আ.) এর তাবুর কাছাকাছি ছিল কিন্তু ইমাম তাদের উপরে আগে হামলা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন যে হামলা যেন আগে তাদের পক্ষ থেকে হোক।
ওমরে সাআদ ইমাম হুসাইন (আ.) এর তাবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করে এবং বলে তোমরা সাক্ষি থাক যে, আমি সর্বপ্রথম ইমাম হুসাইন (আ.) এর তাবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করলাম! তারপর এজিদী বাহিনীরা একত্রে তীর নিক্ষেপ করা শুরু করে।
যুদ্ধের প্রথম হামলাতে চারজন শহীদ হয় এবং এর পরে একক যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে সাহাবী শহীদ হয় এবং তারপরে আহলে বাইতের সদস্যরা শহীদ হয়। অবশেষে ইমাম হুসাইন (আ.) একা থেকে যান। যখন ইমাম তাবুর বাচ্চা এবং নারীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কারবালার ময়দানে যুদ্ধে আসেন এবং আবার সবাইকে হজরত আলী (আ.) এর যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি কারবালাতে এক নজির বিহিন যুদ্ধ করেন। কিন্তু শত্রুরা তাঁকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং যে যা পায় পাথর, বল্লম, তীর দিয়ে ইমাম (আ.) এর উপরে হামলা করে। একটি তিন মাথা বিশিষ্ট তীর ইমাম (আ.) এর বুকে এসে বিধে যায়। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম (আ.) এর শরীরে প্রায় এক হাজার তীর বর্শার আঘাত পরিলক্ষিত হয়।
এভাবেই শেরে খোদার সন্তান আধ্যাত্মিকভাবে শাহাদত বরণ করেন এবং ইহলোক কে বিদায় জানিয়ে পরলোকে পাড়ি দেন।
(و سَيَعلَمُ الَّذينَ ظَلَموا اَيَّ مُنقَلَبٍ يَنقَلِبُونَ)
সূত্র: মাদীনে তাক কারবালা, হামরাহে সাইয়াদুশ শোহাদা।
লেখা: এস. এ. এ
আপনার কমেন্ট