শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫ - ১৮:৩৩
কুরআন ও শিয়া-সুন্নি রেওয়াতে মুত'আ বিয়ে

পবিত্র কুরআনের আয়াত ও শিয়া-সুন্নি হাদীসের রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক বহুল আলোচিত মুত’আ বিয়ে সম্পর্কে লিখেছেন জনাব নাজমুল হক।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: "الْمُحْصَناتُ" শব্দটি আভিধানিক অর্থে এমন কিছু বোঝায় যা সুরক্ষিত এবং অন্যের প্রবেশ থেকে সুরক্ষিত। কুরআনে এই শব্দটি তিনটি গ্রুপের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে:

১. পবিত্র এবং সচ্চরিত্র নারী; যেমন আল্লাহ মরিয়ম (আ.) সম্পর্কে বলেন: «الَّتِی أَحْصَنَتْ فَرْجَها» (সুরা তাহরীম, ১২)।

২. বিবাহিত নারী; কারণ স্বামী নারীর সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব বহন করে। এই আয়াতে «الْمُحْصَناتُ مِنَ النِّساءِ» বলতে এই অর্থই বোঝানো হয়েছে।

৩. মুক্ত নারী যারা যুদ্ধবন্দী বা দাসী নয়; কারণ বন্দীত্ব নারীর সতীত্ব এবং লজ্জার আবরণ ছিন্ন করে এবং দাসীদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রচলিত ছিল।

পরবর্তী আয়াতে «الْمُحْصَناتِ الْمُؤْمِناتِ» বলতে এই অর্থই বোঝানো হয়েছে।

"مُسافِحِینَ" শব্দটি "سفاح" থেকে এসেছে, যার অর্থ ব্যভিচার।

৪. কাফির নারীদের জন্য বন্দীত্ব তাদের স্বামীদের থেকে তালাকের সমান; যেমন একজন নারীর ঈমান আনা, যদি তার স্বামী কুফরিতে অবিচল থাকে, তাহলে তার ঈমান আনা তাকে তার স্বামী থেকে আলাদা করে দেয়।

৫. ইসলামে বিবাহিত নারীর সাথে বিবাহ করা হারাম, সে যে ধর্ম বা জাতিরই হোক না কেন। কিন্তু যেহেতু বন্দীত্ব তালাকের সমান, তাই বন্দী নারীকে বন্দীত্বের পর একবার ঋতুস্রাব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং যদি সে গর্ভবতী হয়, তাহলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে তার সাথে কোন ধরনের যৌন সম্পর্ক করা জায়েয নয়। তাকে স্ত্রী বা দাসী হিসেবে গ্রহণ করা কাফিরদের কাছে ফেরত দেওয়া বা তাকে পরিত্যাগ করার চেয়ে উত্তম।

"متعة" শব্দটি হজ্জ, সালাত, রিবা এবং গনীমতের মতো শব্দের মতো শরয়ী অর্থ বহন করে; আভিধানিক অর্থ নয়। তাই তাফসীরে আল মীযানে আল্লামা তাবাতাবায়ির বক্তব্য অনুযায়ী এতে কোন সন্দেহ নেই যে, «اسْتَمْتَعْتُمْ» বাক্যটির অর্থ মুত'আ।

মুত'আর ক্ষেত্রে «فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ» বাক্যটি দ্বারা উপভোগের বিনিময় প্রদান বোঝানো হয়েছে; «فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ» বাক্যটি দ্বারা যদি স্থায়ী বিবাহ বোঝানো হয়, তাহলে আক্দ পড়ার সময় মোহরানা প্রদান করা আবশ্যক; উপভোগ হোক বা না হোক। কিন্তু সহবাসের আগে যদি তালাক হয়ে যায়, তাহলে অর্ধেক মোহরানা প্রদান করতে হবে।

«فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ» বাক্যটি আহলে বাইত (আ.) এর বক্তব্য অনুযায়ী (উসুলে কাফী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৪৪৮, ওয়াসায়েল, খণ্ড ২১, পৃষ্ঠা ৫) এবং অধিকাংশ সুন্নী তাফসীর অনুযায়ী এই আয়াতটি মুত'আ বিবাহের সাথে সম্পর্কিত, যা দ্বিতীয় খলিফা হারাম ঘোষণা করেছিলেন; যদিও আল্লাহর বিধান হারাম করার অধিকার কারো নেই। যদি এটি হারাম না হতো, তাহলে রেওয়ায়েত অনুযায়ী (তাফসীরে কাবীর, ফাখরে রাযী,সংশ্লিষ্ট আয়াতের নীচে) দুর্ভাগা ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হতো না। মুত'আ বিবাহ একটি সঠিক সমাধান এবং এই সমাজ এটির অভাবে যিনা ব্যভিচারকে মুক্ত ও অবাধ করেছে। মুত'আ বিবাহ একটি সামাজিক প্রয়োজন এবং সুন্নী রেওয়ায়েতে আমরা পড়ি, মুত'আ এর বৈধতা স্ত্রী থেকে দূরে থাকা এবং যুদ্ধের উদ্ভবের কারণে ছিল, যা এখনও বিদ্যমান। মুত'আ এই সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং অশ্লীলতা প্রতিরোধের একটি সমাধান এবং কিয়ামত পর্যন্ত এর শরয়ী বৈধতা থাকবে।

এই সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম  রেওয়ায়েতটি হল নিম্নরুপ যা আহলে সুন্নাতেরবি ভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।

وقد صحّ أنّ عمر رضي اللّه عنه نهي الناس عن المتعة فقال: متعتان كانتا علي عهد رسول اللّه صلى اللّه عليه وسلم وأنا أنهي الناس عنهما ؛متعة النساء، ومتعة الحج

এটি সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, দ্বিতীয় খলীফা লোকদেরকে মুত'আ থেকে নিষেধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন: "দুই ধরনের মুত'আ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় বৈধ ছিল, আর আমি লোকদেরকে এ দুটি থেকে নিষেধ করছি; নারীদের সাথে মুত'আ এবং হজ্জে মুত'আ।"

قال يحيى بن أكثم لشيخ بالبصرة: بمن اقتديت في جواز المتعة؟ قال: عمر بن الخطاب رضي اللّه عنه. قال: كيف وعمر كان أشدّ الناس فيها؟ قال: لأنّ الخبر الصحيح أنّه صعد المنبر فقال: إنّ اللّه ورسوله قد أحلاّ لكم متعتين وإنّي محرّمهما عليكم وأعاقب عليهما. قبلنا شهادته ولم نقبل تحريمه.

ইয়াহইয়া ইবনে আকসাম বসরার এক শাইখকে জিজ্ঞাসা করলেন: "মুত'আর বৈধতার ক্ষেত্রে আপনি কার অনুসরণ করেছেন?" 
শাইখ বললেন: "উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর।" 
ইয়াহইয়া বললেন: "কীভাবে? অথচ উমর মুত'আর ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর ছিলেন!" 
শাইখ বললেন: "কারণ সহীহ রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি (দ্বিতীয় খলীফা) মিম্বারে উঠে বলেছিলেন: 'নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদের জন্য দুটি মুত'আকে হালাল করেছেন, আর আমি (দ্বিতীয় খলীফা) তা তোমাদের উপর হারাম করছি এবং এর জন্য শাস্তি দেব।' সুতরাং আমরা তাঁর সাক্ষ্য (আল্লাহ ও রাসূলের হালাল করার বিষয়ে) গ্রহণ করেছি, কিন্তু তার (দ্বিতীয় খলীফার) হারাম করার বিষয়টি গ্রহণ করিনি।" (মুহাযারাতুল আদাবা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২১৪)

এই রেওয়ায়েতটি থেকে বোঝা যায় যে, দ্বিতীয় খলীফা মুত'আ নিষিদ্ধ করলেও কিছু লোক তাঁর এই নিষেধাজ্ঞা মানেনি এবং তারা আল্লাহ ও রাসূলের হালাল করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে।

এগুলো বাদেও আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে এই বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে যেখানে মুতআ বিবাহের বৈধতার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে৷নিচে তেমনই কিছু গ্রন্থের রেফারেন্স দেয়া হল-

১. আল-মাবসূত লিস-সারখাসী, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৭ 

২. উসূলুস-সারখাসী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬ 

৩. মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩২৫, হাদীস নং ১৪৫১৯ 

৪. আল-মুগনী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১৩৬, দারুল ফিকর প্রকাশনী, ১৪০৫ হিজরী 

৫. আহকামুল কুরআন লিল-জাসসাস, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৪৭, দারু ইহইয়া আত-তুরাস আল-আরাবী প্রকাশনী 

৬. তাফসীরুল কুরতুবী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৯২ 

৭. তাযকিরাতুল হুফফায, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৬৬ 

৮. আত-তাফসীরুল কাবীর, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩০, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, প্রথম সংস্করণ 

৯. বিদায়াতুল মুজতাহিদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৪৪, দারুল ফিকর, বৈরুত 

১০. ওয়াফায়াতুল আ'য়ান ওয়া আনবাউ আবনাইয যামান, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৫০, দারুস সাকাফাহ, লেবানন 

এই রেওয়ায়েতটি দ্বিতীয় খলীফার সময়ে মুত'আ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এটি আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ কিতাবে সংরক্ষিত রয়েছে।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha