সোমবার ২৪ মার্চ ২০২৫ - ১১:১৯
লাইলাতুল কদরে বার্ষিক তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা কী?

জগতের বুকে কিছু দুর্লভ "অমৃত" রয়েছে, যা একদিকে মানুষের অন্তরকে প্রশান্তি দেয়, অন্যদিকে তার ভাগ্যকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।

আলোচনা: ওস্তাদ শুজায়ী

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, লাইলাতুল কদরে তাকদির আকর্ষণ এবং পরিবর্তনে দোয়ার ক্ষমতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

জগতের বুকে কিছু দুর্লভ "অমৃত" রয়েছে, যা একদিকে মানুষের অন্তরকে প্রশান্তি দেয়, অন্যদিকে তার ভাগ্যকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। দোয়া সেই ধরনের এক অমৃত, যা আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহ হিসেবে দান করেছেন, যেন তা মানুষের চিরস্থায়ী আশ্রয় হয়ে থাকে। দোয়া এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন এবং আল্লাহর অনুগ্রহ বয়ে আনতে সক্ষম।

পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, মানুষের জন্য যে তাকদির নির্ধারিত হয়, তা মূলত তার নিজস্ব কর্ম, চিন্তা ও নিয়তের ফলাফল। অর্থাৎ, আমাদের তাকদির আমাদেরই কর্মের প্রতিফল। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এক অবধারিত এবং অপরিবর্তনীয় বিধান নয়। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং পছন্দের অধিকার দিয়েছেন। সৃষ্টির সব ঘটনাই কোনো না কোনো কারণ এবং প্রভাবের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। দোয়া এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা মানুষের ভাগ্যের মানচিত্র অঙ্কনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটি দৃষ্টান্ত কল্পনা করুন: এমন এক দুর্লভ অমৃত যদি "লাইলাতুল কদর" নামক এক অসীম শক্তিধর সময়ের মাঝে স্থাপন করা হয়, তাহলে সেই সমন্বয় সহজেই বিশ্বের সকল হিসাব এবং নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি বদলে দিতে পারে এবং মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ তাকদির আকর্ষণ সহজ করে দিতে পারে।

লাইলাতুল কদরে তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন এক পথ উন্মুক্ত করে, যা আমাদের জন্য অসম্ভব তাকদিরকেও সম্ভব করে তুলতে পারে। তবে দোয়া কবুল হওয়ার নিজস্ব নিয়ম এবং শর্ত রয়েছে। কেবল লাইলাতুল কদরে দোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জানা এবং দোয়া উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়। বরং দোয়ার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে এবং তা অর্জনের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

শ্রেষ্ঠ তাকদির আকর্ষণের জন্য দোয়ার সঠিক পদ্ধতি ও শর্তাবলি রয়েছে। যেমন—

আকাঙ্ক্ষিত তাকদির লাভের জন্য আন্তরিক ও সচেতন প্রচেষ্টা।

সত্যিকারের খাঁটি অন্তরের মাধ্যমে বিনীত ও নির্ভরশীল দোয়া।

অহংকারী মনোভাব এবং জাগতিক চাহিদার ভিত্তিতে নয়, বরং আত্মিক উচ্চতার আকাঙ্ক্ষায় দোয়া করা।

দোয়া হচ্ছে লাইলাতুল কদরের "জীবনীশক্তি"। যদি আমরা এর প্রকৃত রীতি এবং কলাকৌশল না জানি, তাহলে অমূল্য রত্নকে তুচ্ছ কিছু দিয়ে বদলে দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। আমাদের মন জগতের বিশালত্বের তুলনায় সীমিত। আমরা নিজের প্রকৃত কল্যাণ এবং তার জন্য শ্রেষ্ঠ তাকদির সম্পর্কে জানি না। কেবল আল্লাহ এবং তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি অর্থাৎ আহলে বাইত (আ.) আমাদের অন্তরের প্রকৃত চাহিদা এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেষ্ঠ তাকদির সম্পর্কে অবগত।

অতএব, আমাদের উচিত শ্রেষ্ঠ তাকদির আহলে বাইতের (আ.) শেখানো দোয়া এবং মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কামনা করা। এই দোয়া এবং মুনাজাত আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ তাকদিরের মানচিত্র এবং পথনির্দেশনা।

দোয়ার মাধ্যমে তাকদির অর্জন এবং পরিবর্তনের প্রভাব

পূর্বে আমরা "কাযা" ও "কাদর" (বিধান ও ভাগ্য) প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি যে, মানুষের ভাগ্য তার কর্ম ও নিয়তের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। কারণ এবং ফলাফলের নিয়ম অনুযায়ী জগতে সব ঘটনা সংঘটিত হয়।

দোয়া হচ্ছে সেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা মানুষের ভাগ্যে প্রত্যক্ষ প্রভাব রাখে। এমনকি কোনো নির্ধারিত তাকদির দোয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে। এ কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
"দোয়া আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্তকেও বদলে দিতে পারে, এমনকি তা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হলেও।"

ইমাম মূসা কাজিম (আ.)-এর বর্ণনায় এসেছে:
"প্রচুর দোয়া করো। কারণ দোয়া এমনকি সেই বিপদকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।"

দোয়া হচ্ছে ইবাদতের প্রাণ। শরীর থেকে যদি প্রাণ বেরিয়ে যায়, তাহলে তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তেমনি ইবাদতের প্রাণও হচ্ছে দোয়া। দোয়ার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর দয়া এবং অনুগ্রহের প্রতি নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারে। কুরআনে এসেছে:
"বল, যদি তোমাদের দোয়া না থাকত, তাহলে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোনো গুরুত্ব দিতেন না।" (সূরা ফুরকান: ৭৭)

দোয়া মানুষের চরিত্র এবং নৈতিক গুণাবলির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অহংকার এবং আত্মতুষ্টির মতো নৈতিক দুর্বলতা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হচ্ছে দোয়া। আল্লাহ অহংকারকে অবজ্ঞা করেন এবং দোয়া ত্যাগকে অহংকারের লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছেন।

এখন কল্পনা করুন, এই শক্তিশালী দোয়ার অমৃত যদি লাইলাতুল কদরের মতো এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সময়সীমায় স্থাপন করা হয়, যার ফলাফল হাজার মাসের সমান, তাহলে তা "নূরুন আলা নূর" (আলোর ওপর আলো) হয়ে যাবে।

লাইলাতুল কদর এক বিস্ময়কর সময়ের প্রবাহ, যা আমাদের জীবনের সূচনায় ফিরিয়ে নিতে পারে। এই রাতে মানব জীবনের সব ক্ষেত্র—পরিবার, অর্থনীতি, সমাজ, স্বাস্থ্য, মৃত্যু এবং আত্মিক সম্পদ—সবকিছুর তাকদির নির্ধারিত হয়। এমনকি আত্মিক উন্নতি, ইবাদত, আত্মশুদ্ধি, তাওবা, উদ্যম, অলসতা—সবকিছু নির্ধারণ হয় এই রাতে।

অতএব, প্রজ্ঞার নির্দেশ হচ্ছে যে, এই রাতে দোয়ার ভূমিকা যথাযথভাবে গ্রহণ করা। আন্তরিক ও বিনীত দোয়া আমাদের জীবনকে সর্বোত্তমভাবে বিন্যস্ত করতে পারে, এমনকি আমাদের পূর্বের কর্ম ও অবস্থান দুর্বল হলেও। লাইলাতুল কদরের দোয়া আমাদের ভবিষ্যৎ তাকদিরের সুন্দরতম রূপ দিতে সক্ষম।

উপসংহার

লাইলাতুল কদরে তাকদির আকর্ষণের জন্য দোয়া এক অতুলনীয় সুযোগ। এই রাতে আন্তরিক চাওয়া, বিনয় এবং আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা নিজের তাকদিরকে নতুনভাবে রচনা করতে পারি। প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যে এই রাতের মূল্য উপলব্ধি করে, আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করে এবং আহলে বাইতের (আ.) শেখানো দোয়ার মাধ্যমে নিজের ভাগ্য উন্নত করার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে।

দোয়া কবুল হওয়ার প্রধান পথসমূহ

এই আলোচনাটি পড়ে হয়তো আমাদের মনে হতে পারে যে, যখন আমরা দোয়ার ভূমিকা এবং তাকদির আকর্ষণে এর শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছি, তখন কেবল মৌখিক দোয়ার মাধ্যমেই তাকদির পরিবর্তন করা বা সর্বোত্তম তাকদির আকর্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু এই ধারণাটি কি সত্য? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা দুটি অংশে বিশ্লেষণ করব:

১. দোয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা

এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর আমাদের দিয়েছেন ইমাম রেজা (আ.):
"যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাওফিক (সফলতা) কামনা করে, কিন্তু এর জন্য কোনো চেষ্টা করে না, সে নিজেকেই উপহাস করছে।"

অর্থাৎ, মানুষকে তার দোয়া ও চাওয়া অনুযায়ী বাস্তবে কাজ করতে হবে, যেন সে দোয়ার মাধ্যমে আকর্ষিত তাকদিরকে সফলভাবে গ্রহণ করতে পারে।

কেউ যদি সবসময় ঘরে বসে থাকে এবং আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করে, তাহলে কি সে কখনো প্রচুর সম্পদের আশা করতে পারে? কেউ যদি তার জীবনধারা এবং চিন্তাধারা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নির্দেশনা ও ইমামের পথের বিপরীত হয়, তাহলে কি সে ইমামের সঙ্গে এই দুনিয়া ও আখিরাতে থাকার আশা করতে পারে?

ঠিক যেমনভাবে দোয়ার ভূমিকা সম্পর্কে অবহেলা করা উচিত নয়, তেমনি দোয়ার ফলাফল লাভের শর্ত এবং নিয়মকানুনও অবহেলা করা উচিত নয়। যে তাকদির আমরা আকর্ষণ করতে চাই, তার জন্য আমাদের অবশ্যই আন্তরিক ও অবিচল প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দোয়া আমাদের জন্য পথ খুলে দেয় এবং তাকদির আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করে, কিন্তু তাকদির লাভ করা আমাদের নিজের চেষ্টা ও সাধনার ওপর নির্ভরশীল।

দোয়া শুধুমাত্র উচ্চারণ করা নয়, বরং তা প্রকৃতপক্ষে চাওয়া। দোয়া পড়ার অর্থ হল আন্তরিকতার সঙ্গে চাওয়া। যতক্ষণ না মানুষ তার জীবনধারা এবং আচরণকে আহলে বাইতের (আ.) জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে, তার দোয়া কেবল তার প্রবৃত্তির তাড়নায় উচ্চারিত শব্দ হয়েই থাকবে এবং তা নিষ্ফল হবে।

উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি চায় যে, তিনি আল্লাহর ন্যায়পরায়ণ শাসনের অংশ হবেন, তবে তার উচিত হবে আত্মশুদ্ধি, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ইমামের আগমনের প্রস্তুতির জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চালানো। কিন্তু যদি সে এই লক্ষ্যে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে তার দোয়া কেবল মুখের কথা হয়েই থাকবে।

২. দোয়া – বিনীত ও আজ্ঞাবহ দাসের মতো, অহংকারী শাসকের মতো নয়

লাইলাতুল কদরের রাতে তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুস্তরপূর্ণ। আমাদের এই ভূমিকার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে, যেন আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারি।

যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাতে নিজের মন থেকে অহংকার, ভুল ধারণা, আল্লাহর কাছে পাওয়ার দাবি, অবাস্তব কল্পনা এবং এই দুনিয়ার সম্পদের প্রতি মোহ দূর করতে ব্যর্থ হয়, সে দোয়া করেও প্রকৃত অর্থে কিছুই অর্জন করতে পারবে না।

লাইলাতুল কদরের রাতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি তিনিই, যিনি আল্লাহর দরবারে সর্বাধিক বিনীতভাবে নিজেকে নিবেদন করেন। সেই ব্যক্তি নয়, যে অহংকারপূর্ণ এবং দাবি জানিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। মানুষকে দোয়ার মাধ্যমে তার অন্তর থেকে সব প্রবৃত্তির প্রভাব দূর করতে হবে, যেন তার আত্মা নতুন এবং উন্নত নৈতিকতা ও মানবীয় পূর্ণতা গ্রহণের যোগ্য হয়ে ওঠে।

তাকে এমনভাবে আল্লাহর কাছে চাওয়া উচিত, যেন আল্লাহ তার প্রয়োজনীয়তা ও অসহায়তা অনুভব করেন এবং তার জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গল নিশ্চিত করেন। কারণ মানুষ এমন কিছু চাহিদা আল্লাহর কাছে জানাতে পারে, যা তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার এমন কিছু তাকদির সে অস্বীকার করতে পারে, যা তার প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।

তাই আল্লাহর সামনে অহংকার করা উচিত নয়। বরং বিনীতভাবে আল্লাহর হাতে নিজের সব চাওয়া এবং জীবনের কল্যাণ অর্পণ করা উচিত।

৩. তাকদির আকর্ষণের জন্য বিনয় ও গ্রহণযোগ্যতা

তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে আমাদের আল্লাহর কাছে এই মর্মে দোয়া করা উচিত:
"হে আল্লাহ! যদিও আমার হাত খালি, তবুও আমি মহত্ত্ব এবং জীবনযাত্রার উচ্চ স্তরে পৌঁছানোর ইচ্ছা পোষণ করি। আমি এমন একটি আন্তরিক ও শক্তিশালী মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি, যা আপনার নির্ধারিত তাকদির গ্রহণের জন্য প্রস্তুত।"

আল্লাহ মানুষের হৃদয়ের গভীর সত্যতা সম্পর্কে অবগত। তিনি মানুষের আন্তরিক চাওয়া এবং প্রকৃত প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত। তাই আমাদের উচিত আমাদের দোয়ার মান এবং উচ্চতাকে সাধারণ দুনিয়াবি চাওয়ার বাইরে উন্নীত করা।

তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকার আলোকে, আমাদের আল্লাহর কাছে দুনিয়াবি সফলতার জন্য নয়, বরং প্রকৃত মানবীয় পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য দোয়া করা উচিত।

লাইলাতুল কদরের রাতে আমাদের দোয়ার উচ্চতা এমন পর্যায়ে থাকা উচিত, যাতে আমরা শুধু নিজের জন্য নয়, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের কল্যাণ এবং তাদের উত্তম তাকদির লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। দোয়ার প্রকৃত লক্ষ্য শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার উন্নতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।

তাই তাকদির আকর্ষণের জন্য আমাদের দোয়া হতে হবে বিনীত, আন্তরিক এবং সামগ্রিক কল্যাণকামী। আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা এবং বিনয়ই আমাদের প্রকৃত সাফল্যের চাবিকাঠি।


সেরা দোয়ার পদ্ধতি ও ধরণ

দোয়ার ভূমিকা তাকদির আকর্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, সর্বোত্তম ফল লাভের জন্য আমাদের উচিত সর্বোত্তম পদ্ধতি অবলম্বন করা। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত এবং আমরা জগতের সমস্ত ঘটনা ও তার সূক্ষ্মতাগুলি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম নই। রমজান মাসও এমন এক মহান রহস্য ও অলৌকিকতা, যার প্রকৃত অর্থ এবং গূঢ় তাৎপর্য কেবল আল্লাহ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারেন।

রমজান মাসের সমস্ত আমল ও দোয়া আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞা অনুসারে এবং মানুষের আত্মার কাঠামোর জটিল হিসাব অনুযায়ী নকশা ও বিন্যাস করা হয়েছে। তবে মানুষ একা এবং পথপ্রদর্শক ছাড়া এই মহামূল্য সুযোগের সর্বোত্তম ফায়দা গ্রহণে সক্ষম নয়। এজন্যই তাকে এমন ব্যক্তিদের আশ্রয় নিতে হবে, যাঁরা এই পথের বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং সকল দিক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন।

আহলে বাইত (আ.) হলেন সেই পবিত্র ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা মানুষকে সর্বোত্তম তাকদির অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দোয়া ও আধ্যাত্মিক কৌশল শিখিয়েছেন। একজন সচেতন ও বিচক্ষণ ব্যক্তি কখনো আহলে বাইতের (আ.) প্রদত্ত এই অমূল্য শিক্ষা ও পথনির্দেশনা থেকে বিমুখ হয় না। কারণ মানুষ নিজে কখনো তার জন্য উপযুক্ত ও সর্বোত্তম দোয়া এবং কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জন্য সর্বোত্তম তাকদির সেই দোয়া ও মুনাজাতেই নিহিত, যা আহলে বাইত (আ.) থেকে পাওয়া গেছে। এই দোয়াগুলিই প্রকৃত পথপ্রদর্শক এবং এগুলির মাধ্যমে আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করাই হল প্রকৃত সাফল্যের চাবিকাঠি।

আল্লাহর দরবার অত্যন্ত পবিত্র ও মহান। কলুষিত হৃদয় ও অহংকারপূর্ণ মন নিয়ে এই পবিত্র আশ্রয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর নির্ভেজাল ও পবিত্র নিদর্শনসমূহের আশ্রয়ে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রবেশ করতে হবে। যদি আমরা আল্লাহর পরিপূর্ণ অনুগ্রহ ও মহিমার দরবারে প্রবেশ করতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই পৃথিবীতে আল্লাহর নিখুঁত নিদর্শন অর্থাৎ আহলে বাইতের (আ.) সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। এটি এমনই যে, একটি শিশু যখন বিদ্যালয়ে কোনো অপরাধ করে, তখন সে তার পিতার হাত ধরে তার মর্যাদা ও সুনামের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ফিরে আসে।

ইমাম হাদি (আ.) অত্যন্ত সুন্দরভাবে এই বিষয়টি "জিয়ারাতে জামিয়া কাবিরা"-তে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন:
"যে ব্যক্তি আল্লাহর অভিমুখে যেতে চায়, সে তোমাদের মাধ্যমে যেতে পারে। যে আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করে, তার তাওহিদও তোমাদের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। যে ব্যক্তি সত্যের পথে যেতে চায়, সে তোমাদের পথ অনুসরণ করে।"

দোয়ার ভূমিকা ও প্রকৃত শক্তি
তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আমাদের জানতে হবে যে, অধিকাংশ মুনাজাত ও দোয়া আহলে বাইতের (আ.) মাধ্যমে "সালওয়াত" উচ্চারণের মাধ্যমে শুরু হয় কেন। এর কারণ হল, সালওয়াত হল সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির এবং একটি মহামূল্যবান পন্থা, যা মানুষকে তার আধ্যাত্মিক শেকড় তথা স্বর্গীয় পরিবার তথা আহলে বাইতের (আ.) সঙ্গে সংযুক্ত করে। সালওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমতের পথে যেকোনো বাধা দূর হয়ে যায় এবং দোয়ার প্রকৃত প্রভাব বাস্তবায়িত হয়।

এই প্রবন্ধে আমরা তাকদির আকর্ষণে দোয়ার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। এরপর আমরা দোয়া কবুলের প্রধান পথসমূহ সম্পর্কে আলোকপাত করেছি, যার মধ্যে রয়েছে – দোয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টা এবং বিনীত ও আন্তরিক মনোভাব নিয়ে দোয়া করা। আমরা জেনেছি যে, তাকদির আকর্ষণের জন্য প্রথমে আমাদের অন্তর থেকে খারাপ প্রবৃত্তি ও অহংকার দূর করতে হবে এবং এরপর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

সর্বোত্তম দোয়ার পদ্ধতি
সর্বোত্তম দোয়ার পদ্ধতি হল, আহলে বাইতের (আ.) শেখানো দোয়া ও পথনির্দেশনা অনুসরণ করা। এই দোয়াগুলিই মানুষকে তার প্রকৃত তাকদির চিনতে এবং তা অর্জনে সক্ষম করে। আহলে বাইতের (আ.) শেখানো এই দোয়াগুলি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির পথই নির্দেশ করে না, বরং মানবজীবনের বাস্তব চাহিদাগুলোও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তাই, তাকদির আকর্ষণের জন্য দোয়ার সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আহলে বাইতের (আ.) মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা এবং তাঁদের শেখানো দোয়া ও শিক্ষা অনুসরণ করাই হল প্রকৃত সফলতা এবং সর্বোত্তম তাকদির অর্জনের চাবিকাঠি।

অনুবাদ: আম্মার সাবিল

ইসলামী_সংস্কৃতি_জীবনধারা_তিব্ব

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha