মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫ - ১৫:৫৪
হযরত হামজা (আ.): রাসুল (সা.)-এর প্রিয় চাচা ও ইসলামের অকুতোভয় সিংহ

হযরত হামজা (আ.) এমন এক মহান ব্যক্তি ছিলেন যাকে মক্কার মানুষ “আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ)” ও “আসাদুর রাসুল (রাসুলের সিংহ)” উপাধিতে ভূষিত করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাসুলুল্লাহর (সা.) প্রিয় চাচা ও ইসলামি ইতিহাসের মহান বীর হামজা (আ.) সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরছি:

প্রাক-ইসলামিক জীবন ও বংশমর্যাদা
হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (আ.) কুরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ফুফু হালার সন্তান হওয়ায় নবীজির সাথে তাঁর রক্তের সম্পর্ক ছিল। মক্কার সমাজে তিনি ”আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ)” ও ”আসাদুর রাসুল (রাসুলের সিংহ)” উপাধিতে ভূষিত হন। ইসলামপূর্ব যুগেও তিনি তার সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বীরত্বের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। 

ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা
হযরত হামজা (আ.) প্রাথমিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেননি, কিন্তু একটি ঘটনা তাঁর জীবনে পরিবর্তন আনে। একদিন আবু জাহেল রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রকাশ্যে অপমান করে এবং কাবা প্রাঙ্গণে তাঁকে লাঞ্ছিত করে। এই সংবাদ শুনে হামজা (আ.) অগ্নিশর্মা হয়ে আবু জাহেলের কাছে যান এবং তার ধনুক দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করে বলেন, “তুমি কি তাঁকে গালি দাও, যখন আমি তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেছি?”

এই ঘটনার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ঘোষণা করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ মক্কার কাফিরদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল, কারণ তিনি ছিলেন মক্কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও সম্মানিত ব্যক্তি। 

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে অটল ভূমিকা
হামজা (আ.) ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একনিষ্ঠ সাহাবি ও রক্ষাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বদর যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার ভাই শাইবা ইবনে রাবিয়াকে পরাজিত করেন। 

ওহুদ যুদ্ধ: বীরত্ব ও শাহাদাত
ওহুদ যুদ্ধে (৩ হিজরি) হামজা (আ.) “আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ)” উপাধির যথার্থতা প্রমাণ করেন। তিনি একটি বর্শা ও তরবারি নিয়ে শত্রুদের মাঝে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন এবং একাই বহু কাফির সৈন্য হত্যা করেন। 

কিন্তু এই যুদ্ধে কুরাইশদের চক্রান্তে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওয়াহশি নামক এক হাবশী দাসকে হামজা (আ.)-কে হত্যার জন্য প্ররোচিত করে। ওয়াহশি একটি বর্শা দিয়ে হামজা (রা.)-এর পেটে আঘাত করে তাঁকে শহীদ করে। 

এরপর হিন্দা বিনতে উতবা হামজা (আ.)-এর দেহ থেকে কলিজা বের করে মুখে দিয়ে চিবায় এবং তাঁর নাক-কান কেটে নেয়। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক অধ্যায়। 

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শোক ও হামজা (আ.)-এর বিশেষ মর্যাদা
রাসুলুল্লাহ (সা.) হামজা (আ.)-এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি তাঁকে “সাইয়্যিদুশ শুহাদা (শহীদদের নেতা)” উপাধি দেন। শিয়া মুসলমানদের মতে, হামজা (আ.) শুধু একজন সাধারণ সাহাবিই নন, বরং তিনি আহলে বাইত (আ.)-এর একজন সমর্থক ও নবীজির পরিবারের জন্য উৎসর্গপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। 

ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.) প্রায়ই হামজা (আ.)-এর বীরত্বের কথা স্মরণ করতেন এবং কারবালার যুদ্ধে হামজা (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। 

শিয়া ও সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গিতে হামজা (আ.)
শিয়া ও সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ই হামজা (রা.আ.)-কে শ্রদ্ধা করে, তবে শিয়া মাজহাবে তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়, কারণ: 

১. তিনি ছিলেন আহলে বাইতের (আ.) সমর্থক। 

২. তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর মতোই নিঃস্বার্থভাবে ইসলামের জন্য লড়াই করেছিলেন। 

৩. তাঁর শাহাদাত কারবালার শাহাদাতের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়। 

হামজা (আ.)-এর উত্তরাধিকার

- তাঁর শাহাদাত মুসলিম উম্মাহর জন্য ত্যাগ ও সাহসিকতার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। 

- ইসলামের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত। 

- শিয়া মুসলমানরা বিশেষভাবে আশুরা ও শাহাদাতের ঘটনাবলিতে তাঁকে স্মরণ করে। 

হযরত হামজা (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম দিকের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ সাহাবিদের একজন। তাঁর জীবন ও শাহাদাত আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে ঈমানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে হয়। শিয়া মুসলমানদের নিকট তিনি শুধু একজন সাহাবিই নন, বরং একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব যিনি নবীজির আহলে বাইতের পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। 

“সালাম হোক হযরত হামজার উপর, যিনি আল্লাহর রাস্তায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।”

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha