সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ - ০৯:১৭
শাহাদাত যেন ইরানিদের আরও জাগ্রত করছে

শহীদদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না—এই অমোঘ সত্যের দৃপ্ত প্রতিফলন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে। সাম্রাজ্যবাদ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অনন্য প্রতীক এই দেশটি আবারও আঘাতের মুখে পড়েছে। ইহুদিবাদী দখলদার ইসরায়েল ও তার অভিভাবক যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, সাইবার ও বেসামরিক হামলার শিকার হয়েছে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র, সাধারণ জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো—এই হামলা যেন ইরানিদের মনোবল ভাঙার পরিবর্তে তাদের ঈমান, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুনকে আরও জ্বালিয়ে তুলেছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইসলাম ও মুসলমানদের কুরআন ঘোষিত শত্রুদের বিরুদ্ধে যখন অন্যান্য মুসলমান দেশগুলো নতজানু, সেখানে ইরান খায়বার বিজয়ী ইমাম আলী (আ.)-এর আদর্শিক শক্তি নিয়ে তাদের মুখোমুখি হয়েছে। 

চলতি মাসের ১৩ তারিখ থেকে ইহুদিবাদী দখলদার ইসরায়েল এবং তার পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যেসব হামলা চালিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘনের নামান্তর। পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, সামরিক স্থাপনা, এমনকি বেসামরিক জনগণ ও ধর্মীয় স্থান পর্যন্ত এদের নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিশেষ করে গাজার গণহত্যার প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে ইরানকে চাপে রাখার এই অপচেষ্টা, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের স্বাধীনচেতা মানুষের হৃদয়ে ঘৃণা ও প্রতিরোধের বীজ আরও গভীরে বপন করেছে।

জবাব কী ছিল? নীরবতা নয়, বরং ঈমানি জাগরণ!
এই অবস্থায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ হয়তো আতঙ্কগ্রস্ত হতো, বিচ্ছিন্নতাবাদে ভুগতো, কিংবা নিরাপত্তার অজুহাতে নিজেদের ধর্মীয় কার্যক্রম স্থগিত করতো। কিন্তু ইরানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেছে।

আকাশপথে আকস্মিক ও অনবরত হামলার মধ্যেও জুমার নামাজে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে, আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।

প্রতিটি শহীদের জানাজায় মানুষ যেন ঢল নামিয়ে দিয়েছে—এটি শুধুই শোক নয়, বরং শহীদদের আদর্শকে বুকে ধারণ করার এক নীরব শপথ।

পবিত্র স্থানগুলোতে মানুষ পূর্বের তুলনায় আরও বেশি সমবেত হচ্ছে, যেন তারা ঘোষণা দিচ্ছে—“আমরা ভয় পাই না, কারণ শাহাদাত আমাদের জন্য পরাজয় নয়, বরং ইজ্জতের পথ।”

রাজপথে ইসরায়েল-আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্লোগান আর মিছিল যেন এই বার্তাই দিচ্ছে: ইমান কখনও দমন করা যায় না।

শাহাদাত: একটি জাতির নবজাগরণের মশাল
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাসে শাহাদাত কেবল মৃত্যু নয়—এটি চেতনার আলো। শহীদ মুর্তজা মুুতাহারি একদা বলেছিলেন, “যে জাতি শাহাদাতকে বরণ করতে পারে, সে জাতিকে কোনো শক্তি পরাজিত করতে পারে না।” আজ সেই কথার বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে ইরানে।

প্রতিটি শাহাদাত যেন নতুন প্রজন্মের সামনে আদর্শের প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরিবারের শিশুরা বাবার রক্তাক্ত জামা নিয়ে গর্ব করে বলছে, “আমার বাবা হুসাইনের পথে শহীদ হয়েছেন।” এ এক আশ্চর্য বাস্তবতা—যেখানে মৃত্যু ভয় নয়, বরং ঈমানের প্রমাণ।

আন্তর্জাতিক নীরবতা বনাম ঈমানদার প্রতিরোধ
যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বড় শক্তি বর্বরতা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নীরব, তখন ইরান তার জনগণের ঈমানি শক্তিকেই একমাত্র ভরসা করে দাঁড়িয়ে গেছে। এই প্রতিরোধে বাহ্যিক অস্ত্র যত বেশি কার্যকর, তারচেয়েও বেশি কার্যকর হলো ভেতরের আত্মিক প্রস্তুতি, শাহাদাতের আদর্শে বিশ্বাস, এবং আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা।

আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় আত্মপরিবর্তন
ইরানিদের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা এ রকম দিনের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। অতর্কিত হামলা তাদের চমকে দেয় না, বরং ঈমানি উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। শহীদের রক্ত শুধু জমিনে পড়ে না, বরং প্রতিটি সজাগ অন্তরে একটি দীপ্ত আলোকরেখা এঁকে দিয়ে যায়।

কেউ পাশে দাঁড়াক আর না দাঁড়াক, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। জয়-পরাজয় তো একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ। আল্লাহ নিশ্চয়ই এই জাতিকে বিজয়ী করবেন।

কিন্তু এই আত্মিক ও বৈপ্লবিক জাগরণ কেবল ইরানের জন্য নয়—বিশ্বের সকল নির্যাতিত ও দখলকৃত জাতির জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আগ্রাসনের মুখে কীভাবে এক জাতি ঈমানের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে—ইরান তারই বাস্তব নমুনা।

وَلا تَحسَبَنَّ الَّذينَ قُتِلوا في سَبيلِ اللَّهِ أَمواتًا ۚ بَل أَحياءٌ عِندَ رَبِّهِم يُرزَقونَ
“আর যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে, তাদের মৃত ভাবিও না; বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত এবং রিযিকপ্রাপ্ত।”
[সূরা আলে ইমরান: ১৬৯]

লেখা- রাসেল আহমেদ রিজভী 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha