বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫ - ২০:২২
যুদ্ধবিরতিতে ইরানের সম্মতির কারণ ও অর্জন

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বানের পর ইরানের প্রখ্যাত আলেম ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ হুজ্জতুল ইসলাম মোস্তফা হামদানি জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে “ন্যায়সঙ্গত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং কার্যকর” পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: “ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধ: আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে যুদ্ধবিরতির যৌক্তিকতা ও সামরিক সাফল্য” শীর্ষক বিশ্লেষণে তিনি নিজের মতামত প্রকাশ করেন।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: ইসরায়েল ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পর, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কি যুক্তিসঙ্গত ও বৈধ হতো? এ সংঘাত ইরান কী অর্জন করল?

হামদানির বিশ্লেষণ: আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রতিটি দেশের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এ ধরনের প্রতিরক্ষা হতে হবে আক্রমণের মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অতিরিক্ত প্রতিশোধমূলক হওয়া চলবে না। আগ্রাসন প্রতিহত করার পর অতিরিক্ত সামরিক হামলা ‘আক্রমণাত্মক ও বেআইনি’ হিসেবে গণ্য হয়।

এই প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ নেতার সুপরিকল্পিত কৌশলে ১২ দিনের সম্মানজনক প্রতিরক্ষা ও পরবর্তীকালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শত্রুকে কার্যত পিছু হটতে বাধ্য করা—একটি রাষ্ট্রদর্শিতাপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ ছিল। একই সিদ্ধান্ত, যেমন ইমাম খোমেনি (রহ.) ইরাক যুদ্ধের সময় নিয়েছিলেন, যুদ্ধকে শত্রুর ভূখণ্ডে নিয়ে না গিয়ে একটি প্রতিরক্ষা বিজয়ে সীমাবদ্ধ রাখে, যা আন্তর্জাতিক সম্মান বজায় রাখে।

যুদ্ধ থেকে ইরানের সাতটি কৌশলগত অর্জন:

১. ধ্বংসাত্মক জবাব: ইরানের পাল্টা আঘাত ছিল সুনির্দিষ্ট ও ধ্বংসাত্মক। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসের দাবি ছিল অপ্রমাণিত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেলা। বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত যে, পারমাণবিক স্থাপনায় ধ্বংসাত্মক হামলার প্রতিক্রিয়া গোপন রাখা অসম্ভব—যেমনটা ঘটেছিল চেরনোবিল (১৯৮৬) ও ফুকুশিমা (২০১১) দুর্ঘটনায়।

২. মিত্রশক্তির ব্যবহার না করা: হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ, কাতায়েব, আসায়েব প্রমুখ আঞ্চলিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় না করেই ইরান পরিস্থিতি সামাল দেয়।

৩. রাশিয়া ও চীনের সহায়তা না চাওয়া: এ দুই মিত্রদেশের সামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও ইরান তাদের সম্পদ ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছে।

৪. অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা শনাক্ত: ইরান তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা, সাইবার নিরাপত্তা, ফিজিক্যাল ও সফট সুরক্ষা ও নিরাপত্তাগত ঘাটতিগুলো শনাক্ত করে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

৫. জনগণ ও জনমত: ইরানের জনগণের মনে যে প্রশ্ন ছিল—সিরিয়া ও লেবানে কেন এতদিন প্রতিরোধ চলেছে—এখন তারা নিজেরাই বুঝেছে: সেখানকার প্রতিরোধ না থাকলে আরও আগে তেহরান, ইসফাহান কিংবা হামেদানে যুদ্ধ শুরু হত।

৬. জাতীয় ঐক্য পুনর্জাগরণ: বিভক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিরল ঐক্য ও সংহতির আবহ সৃষ্টি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় শক্তির ভিত্তি হয়ে উঠবে।

৭. সর্বোচ্চ নেতার দূরদর্শী নেতৃত্ব আরও স্পষ্ট: সর্বোচ্চ নেতার প্রজ্ঞা, কৌশলগত নেতৃত্ব এবং ধর্মীয় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা এবারের সংকটে আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই যুদ্ধবিরতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে রক্ষা করা। তারা এমন এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল যা তাদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। তাদের প্রতিরক্ষা অস্ত্র প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল এবং কাতারের মধ্যস্থতায় ট্রাম্প বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন।”

যুদ্ধ বিরতির পরের দিনের ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, “গতকালও ছিল ইসরায়েলিদের জন্য এক ভয়ংকর দিন। তারা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেখানে আর এগোনোর ক্ষমতা ছিল না। এই যুদ্ধবিরতি ছিল একরকম বাঁচার পথ।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha