রবিবার ১৭ আগস্ট ২০২৫ - ১০:২১
মিডিয়া সচেতনতা: আধুনিক মিডিয়া যুদ্ধে প্রতিরক্ষার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র

২১শ শতাব্দীতে যুদ্ধ মানেই আর শুধু গোলা-বারুদ বা সামরিক শক্তির সংঘর্ষ নয়। আজকের বড় যুদ্ধ লড়ে হচ্ছে গণমাধ্যমের ভেতরে—যেখানে খবর, তথ্য, প্রচারণা ও অদৃশ্য তরঙ্গই হয়ে উঠেছে শত্রুর অস্ত্র। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এই যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সৈন্য সংগ্রহ করছে আমাদের ঘর থেকেই। আমাদের জনগণকে প্রভাবিত করে, তাদের মনোজগৎ দখল করেই শত্রু এগিয়ে চলছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই বাস্তবতায় প্রশ্ন দাঁড়ায়—আমাদের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা অস্ত্র কী? উত্তর হলো: গণমাধ্যম সচেতনতা।

সবজান্তা হওয়ার বিভ্রান্তি ও FOMO-এর ফাঁদ
আধুনিক গণমাধ্যম মানুষের মনে এক বিভ্রান্তি তৈরি করেছে—আমাদের সবকিছু জানতে হবে। কিন্তু বাস্তবে “সবজান্তা মানসিকতা” আমাদেরকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করছে।

আজকের মিডিয়া সংস্কৃতি অনেকটা ফাস্টফুড ভোগের মতো—অতি দ্রুত, অতি পৃষ্ঠস্থ, আর ফলশ্রুতিতে অতি ক্ষতিকর। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফোমো (FOMO– Fear of Missing Out) বা কিছু মিস হয়ে যাওয়ার ভয়। এই ভয়কে হাতিয়ার করেই গণমাধ্যম কোটি কোটি দর্শক-শ্রোতাকে নিজের পছন্দসই পথে নিয়ে যাচ্ছে।

গণমাধ্যম সচেতনতা: যুক্তিনির্ভর ব্যবহারের দক্ষতা
গণমাধ্যম সচেতনতা মূলত একটি জীবনদক্ষতা। হুজ্জাতুল ইসলাম রাসুল বাহরামিয়ানের মতে, সচেতন দর্শক জানেন কোন বার্তা কোন উদ্দেশ্যে প্রচারিত হচ্ছে। তিনি সহজেই বুঝতে পারেন—বার্তার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য কী।

এমন সচেতনতা মানুষকে জটিল বার্তা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম করে তোলে— হোক তা টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠান, রেডিও সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা, বা বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডের চটকদার বার্তা।

আজকের তথ্য-অতিরিক্ততার যুগে সব জানতে চাওয়া সম্ভব নয়, বরং ক্ষতিকর। গণমাধ্যম সচেতনতার অন্যতম লক্ষ্যই হলো সময়, অর্থ ও মনোযোগকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যবহার করা।

গণমাধ্যম প্রতিরক্ষা: বারো দিনের যুদ্ধের শিক্ষা
সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েল-আমেরিকা যুদ্ধের পর গণমাধ্যম প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গে বিশেষ আলোচনা শুরু হয়। এর মূল ধারণা হলো—ভুল তথ্য, বিভ্রান্তি ও শত্রুর প্রচারণার মোকাবিলা করা।

গণমাধ্যম প্রতিরক্ষার জন্য জরুরি কিছু করণীয় হলো:
গণমাধ্যম সচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্যসূত্র যাচাই, ভুয়া তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা।

গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদেক খোরসান্দ স্পষ্ট করে বলেছেন—গণমাধ্যম প্রতিরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো গণমাধ্যম সচেতনতা। তবে এজন্য বিভিন্ন মিডিয়ার ধরন, সংবাদ পরিবেশনের কৌশল ও বার্তা প্রচারের ধরণ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা জরুরি।

তথ্য মহাসড়কে বাছাইয়ের ক্ষমতা
তথ্যের মহাসড়কে প্রতিনিয়ত আমরা চলাচল করছি। গণমাধ্যম সচেতনতা এখানে আমাদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।

ড. খোরসান্দ এ বিষয়ে একটি সুন্দর উপমা দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণমাধ্যম সচেতনতা অনেকটা খাদ্যাভ্যাসের মতো। যেমন একজন সচেতন মানুষ নিজের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বেছে নেয়, তেমনি গণমাধ্যম সচেতন ব্যক্তি নিজের মানসিক ও বৌদ্ধিক খাদ্যও বেছে নিতে পারে। কারণ মোবাইল, টিভি ও ইন্টারনেট থেকে আসা সব তথ্য সবার জন্য উপযোগী নয়।

গণমাধ্যম সচেতনতার অভাব: ভয়াবহতার দিক
গবেষক শুকরজাদের মতে, গণমাধ্যম সচেতনতার অভাব মানেই মানসিক বিভ্রান্তি। এতে মানুষ ভুল তথ্য গ্রহণ করে, সঠিক-ভুল পার্থক্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে নিজের চিন্তা ও সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ গণমাধ্যমের হাতে তুলে দেয়।

মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও সাইবারযুদ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—গণমাধ্যমযুদ্ধের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র হলো অদৃশ্য তরঙ্গ। চোখে দেখা যায় না, অথচ তা মানুষের মনের গভীরে প্রবল প্রভাব ফেলছে।

পরিসমাপ্তি, আজকের গণমাধ্যমযুদ্ধের বাস্তবতা হলো—শত্রু সৈন্য সংগ্রহ করছে আমাদের সমাজের ভেতর থেকেই। তাই এর মোকাবিলা করতে হলে আমাদের হাতে অস্ত্র হতে হবে জ্ঞান, সচেতনতা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি।

গণমাধ্যম সচেতনতা শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং এটি সমাজে আশা, আস্থা ও দৃঢ় মানসিকতা জিইয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha