হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষমা একটি অমূল্য গুণ; তা শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের মেরামত করে না-সম্প্রদায়ের নৈরাজ্য কমায়, আত্মার ভেতর শান্তি বয়ে আনে এবং সমাজে মানবিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। মির্জা কুম্মি সম্পর্কে যে কাহিনিটি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, তা কেবল এক আলেমের কীর্তি নয়-এটি মানুষের আত্মশুদ্ধি, সহমর্মিতা এবং ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষার এক অকাট্য শিক্ষা। এই প্রবন্ধে আমি ঐ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু করে ক্ষমার অর্থ, তার বিধান ও আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করব।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
একদিন নামাজের সময় মির্জা কুম্মি-এক সুপ্রতিষ্ঠিত আলেম ও উসুলে ফিকহের দার্শনিক-একজন গরিবের হাহাকার শুনে তত্ক্ষণাত্ সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন না; তিনি নামাজ শেষ করার পরই ব্যাখ্যা করবেন বললেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তীব্র অনুরোধকারী রাগে এসে মির্জা কুম্মির মুখে থুতু ছুঁড়ে দেয়। উপস্থিত লোকেরা উত্তেজিত হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে মির্জা দীর্ঘ সময় নীরবে ভাবলেন। বিশ মিনিট চাওয়া সেই সময় ছিল তার চিন্তা ও বিচার বিশ্লেষণের মুহূর্ত। শেষমেশ তিনি বললেন, যুক্তিসঙ্গত ও শরিয়তসম্মত আচরণ হলো ক্ষমা; তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করলেন যে যে-ই তাঁকে ভালোবাসে, সে এই গরিবকে সাহায্য করুক। তিনি কোরআনের আয়াতও উত্থাপন করলেন:
“وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ” “যারা রাগ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে।”
ক্ষমার মর্মার্থ ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট
মির্জা কুম্মির সিদ্ধান্তটি ছিল তর্কবিরুদ্ধ নয়-এটি ধর্মীয় ও নৈতিক গভীর বোঝাপড়ার ফল। কোরআন ও হাদীসে ক্ষমাকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; রাগ দমন করা, অন্যায়ের জবাব মধুরতা ও ধার্মিক উদারচেতনার সঙ্গে প্রদান করা-এসবই প্রকৃত পরিশুদ্ধ আত্মার লক্ষণ। মির্জা এখানে শুধু ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা থেকে বিরত হননি, তিনি সমগ্র সমাজকে নৈতিক শিক্ষাই দিয়েছেন: শাস্তি দিয়ে ক্ষত স্থায়ী করা যায়; কিন্তু ক্ষমা দিয়ে মনের বদল, সম্পর্কের পুনর্গঠন এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
মানবিক ও সামাজিক উপদেশ
ঘটনাটি আমাদের জানায়-বিবেচনা ছাড়া তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নেয়া কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। সামাজিক উত্তেজনা ও সন্ত্রাসের সময় ত্বরিত শাস্তির দাবি সাধারণত উত্থিত হয়; কিন্তু মির্জা দেখালেন যে বিশ্লেষণ ও সহানুভূতি কখনও কখনও আরো অপরিহার্য। ক্ষমা সমাজকে পুনর্মিলিত করে; অপরাধীর লজ্জা ও অনুশোচনা তাকে বদলে দিতে পারে-শাস্তি সবসময় এমন ফল দিতে পারে না। এছাড়া ক্ষমা প্রদানে যে মহিমা রয়েছে, তা ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তি ও আত্মসন্তুষ্টিরও কারণ হয়। ক্রোধ দমন করলে হৃদয় প্রশান্ত হয়; ক্ষমা প্রদানে আল্লাহর কাছে প্রীতিও অর্জিত হয়-এমনটাই ধর্মীয় তত্ত্ব।
আধ্যাত্মিক দিক ও কিয়ামতের বর্ণনা
মির্জা কুম্মি কিয়ামতের দিনের এক উদাহরণ টেনে বলেছিলেন কীভাবে ক্ষমাশীল লোকেরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন। এটি ভীরু অনুশীলনের দিকে উৎসাহ দেয়-অর্থাৎ, শুধুমাত্র আইনগত বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের কারণে ক্ষমা প্রদত্ত করা উচিত। তিনি বলেছিলেন, যারা অন্যায়ের পরেও ক্ষমা করে, তারা সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে; তাদের কাজের নেপথ্যে ছিল নিঃস্বার্থতা-শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ক্ষমা। এই ভিজ্ঞতা প্রতিটি মুসলিমকে অনুপ্রাণিত করা উচিত-দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের হিসাব-নিকাশ করতে এবং ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ আকর্ষণ করতে।
সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা
আজকের বিশ্বের দাঙ্গা, আঘাত, সামাজিক বিভাজন এবং ক্ষুদ্র প্রতিশোধের সংস্কৃতিতে মির্জা কুম্মির পাঠ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। সামাজিক যোগ্যতার যুগে, যখন সংবাদমাধ্যম তড়িৎ প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহ দেয় এবং প্রতিশোধের ডাক উচ্চারণ করে, সেখানে ধৈর্য ও বিচার-বিবেচনা দিয়ে ক্ষমা আহ্বান করা-এটি একটি শক্ত এবং দায়িত্বশীল কাজ। ক্ষমা শিক্ষা ব্যবস্থায়, পরিবারে এবং রাজনীতিতে প্রয়োগ করলে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত কমে যাবে এবং পুনর্গঠন সম্ভব হবে।
শেষ কথা: “ক্ষমা করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না”-এই কথার মর্মকথা বহুমাত্রিক। এটি সাহসিকতার নয়, নকল সাহসিকতার বিপরীতে সত্যিকারের ন্যায় এবং মানবিকতার বিজয়। মির্জা কুম্মির দৃষ্টান্ত আমাদের শেখায়: ক্ষুব্ধ মুহূর্তে বিচক্ষণতা, বিবেচনা ও সহমর্মিতাই প্রকৃত নির্দেশ। যদি আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এই মানসিকতাকে প্রতিষ্ঠা করি, অনেক অনধিকারী বিরোধ, বিদ্বেষ ও বিভাজন দূর হবে। ক্ষমা ব্যক্তিগত মুক্তি ও সামাজিক পুনরুত্থানের মূল চাবিকাঠি-এবং সেই পথেই প্রকৃত শান্তি ও ঐক্য নিহিত।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট