শুক্রবার ১৭ অক্টোবর ২০২৫ - ১২:০২
এক দস্যুর মুখে ইমাম গাজালীর জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা

জ্ঞান অর্জনের পথ সবসময় সরল বা সহজ হয় না কখনও কখনও জীবনের সবচেয়ে গভীর শিক্ষা আসে অপ্রত্যাশিত ও অজানা উৎস থেকে, এমন ব্যক্তির মুখে যারা সমাজে শিক্ষিত বা প্রজ্ঞাবান বলে বিবেচিত হয় না। ইমাম মুহাম্মদ গাজালী, ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, এমনই এক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান পাঠ শিখেছিলেন। এক দস্যুর মুখে উচ্চারিত একটি সরল বাক্য, যা বহিরাগত দৃশ্যে অল্প গুরুত্বের মতো দেখায়, তাঁর চিন্তা ও জীবনধারার দিক পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এটি তাঁকে বোঝায়—যে জ্ঞান কেবল লিখিত বা বাহ্যিক হিসেবে সংরক্ষিত, তা হারিয়ে যেতে পারে; প্রকৃত জ্ঞান হলো সেই যা হৃদয়ে স্থায়ী হয়, যা ব্যক্তিকে চিন্তাশীল, নৈতিক ও সতর্ক করে তোলে। এই উপলব্ধি গাজালীর পরবর্তী চিন্তাভাবনা ও গবেষণার পথনির্দেশনা হিসেবে পরিণত হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম মুহাম্মাদ গাজালী ছিলেন তুস নগরীর সন্তান বর্তমান ইরানের মাশহাদের নিকটে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক অঞ্চল। তাঁর জন্ম এমন এক সময়, যখন নিশাপুর ছিল জ্ঞানের রাজধানী, পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর “দারুল-উলুম” যেখানে মুসলিম জগতের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও চিন্তাবিদেরা একত্রিত হতেন।

ইমাম গাজালী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অতৃপ্ত জ্ঞানপিপাসু। তিনি নেশার মতো অধ্যয়ন করতেন, নোট লিখতেন, প্রশ্ন করতেন, আর প্রতিটি শেখা বিষয় যত্নে সংরক্ষণ করতেন খাতার পর খাতায়। বছরের পর বছর ধরে অর্জিত তাঁর সেই লিখিত জ্ঞানের ভাণ্ডারই ছিল তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—জীবনের পরিশ্রম, চিন্তা ও অস্তিত্বের প্রতিফলন।

ফেরার পথে এক অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ
বছরের পর বছর অধ্যয়নের পর ইমাম গাজালী স্বদেশ ফিরে আসার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলো একটি তোবরায় (পুঁটলিতে) ভরে কাফেলায় যোগ দিলেন। যাত্রাপথে কাফেলা একদল দস্যুর কবলে পড়ল। তারা একে একে সকলের মালপত্র লুট করতে শুরু করল। গাজালীর পুঁটলিও তাদের হাতে পড়ল। ইমাম গাজালী আতঙ্কিত হয়ে অনুরোধ করলেন, “দয়া করে এই পুঁটলিটা নিও না! এতে আছে আমার অর্জিত জ্ঞান এবং শিক্ষাজীবনের ফল। এটি হারালে আমার সমস্ত জ্ঞানই হারিয়ে যাবে।”

দস্যুর মুখে চিরন্তন শিক্ষা
দস্যুরা অবাক হলো। তারা ভাবল, নিশ্চয় এর ভেতরে কোনো মূল্যবান ধন আছে। পুঁটলি খুলে তারা দেখল শুধু কিছু কাগজ, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি।

দস্যু-প্রধান হেসে বলল, “এই কাগজগুলোই কি তোমার ধন? এতে কী এমন আছে যে এত কান্নাকাটি করছো?”

ইমাম গাজালী উত্তর দিলেন, “এগুলোই আমার জ্ঞানের ফল—এগুলো ছাড়া আমি কিছুই নই।”

দস্যু-প্রধান তখন বলল, “তোমার জ্ঞান যদি এই কাগজে বন্দী থাকে, তবে তা কোনো জ্ঞান নয়। যে জ্ঞান পুঁটলিতে থাকে এবং চুরি হয়ে যেতে পারে, তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। ফিরে যাও, নিজের জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবো কারণ তোমার এই জ্ঞান এখনও তোমার ভিতরে জাগেনি।”

এক বাক্যে জীবনের জাগরণ
দস্যুর এই সাধারণ অথচ গভীর কথা ইমাম গাজালীর অন্তরে বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানল। তিনি উপলব্ধি করলেন এতদিনের অর্জিত জ্ঞান কেবল কাগজে বন্দী, হৃদয়ে নয়। সেই দিন থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জ্ঞান কেবল মুখস্থ নয়, চিন্তা, গবেষণা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে হৃদয়ে প্রোথিত করতে হবে।

পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন, “আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপদেশ আমি এক দস্যুর মুখে শুনেছিলাম। সেই বাক্য আমার চিন্তার দিগন্ত বদলে দিয়েছে। আমি শিখেছি—যে জ্ঞান হৃদয়ে স্থায়ী হয়, সেটিই প্রকৃত জ্ঞান; বাকিগুলো কেবল কাগজে বন্দী অক্ষর।”

সত্যিকারের জ্ঞান কোথায় বাস করে
ইমাম গাজালীর এই অভিজ্ঞতা আজও শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন তোলে—জ্ঞান কি কেবল বইয়ের পাতায়, নাকি হৃদয়ে? বই ও পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যে জ্ঞান হৃদয়ে প্রোথিত হয়, তা চিরস্থায়ী। দস্যুর সেই চিরন্তন বাক্য আজও প্রতিধ্বনিত হয়: “যে জ্ঞান চুরি হয়ে যেতে পারে, তা জ্ঞান নয়।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha