হাওজা নিউজ এজেন্সি: ড. রাজিজাদে বলেন, বর্তমানের ডিজিটাল প্রজন্ম একাধিক সামাজিক সংকটের মুখোমুখি—যেমন পরিচয় সংকট, সামাজিক পুঁজি বা বিশ্বাসের ভাঙন এবং সার্বিক অবিশ্বাসের বিস্তার। এই বাস্তবতায় প্রচলিত, নির্দেশনাধর্মী ও শ্রেণিকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে, নাগরিক আচরণ, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ব শেখানোর জন্য এমন নতুন মাধ্যম প্রয়োজন যা তরুণ প্রজন্মের চিন্তা ও আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভিডিও গেম সেই ঘাটতি পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিনোদন থেকে শক্তিশালী শিক্ষামাধ্যমে পরিণতি
তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভিডিও গেম শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে বিবেচিত হলেও, বর্তমানে এটি এক বিশাল শিল্প ও শিক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রাজিজাদে তাঁর গবেষণার তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে ডেভিড কোল্বের অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার তত্ত্ব (Experiential Learning Theory) ব্যবহার করেছেন, যা জন ডিউই ও জ্যাঁ পিয়াজের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, শেখার প্রক্রিয়া চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়—
১. বাস্তব অভিজ্ঞতা (Concrete Experience)
২. পর্যবেক্ষণ ও আত্ম-মনন (Reflective Observation)
৩. অমূর্ত ধারণা গঠন (Abstract Conceptualization)
৪. সক্রিয় প্রয়োগ বা পরীক্ষা (Active Experimentation)
রাজিজাদে ব্যাখ্যা করেন—ইন্টারঅ্যাকটিভ বা অংশগ্রহণমূলক গল্পভিত্তিক গেমগুলো এই চার ধাপের একটি জীবন্ত প্রতিফলন। খেলোয়াড় প্রথমে গেমের অভিজ্ঞতায় প্রবেশ করে (যদিও তা ভার্চুয়াল), এরপর সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করে, নৈতিক বা সামাজিক ধারণা তৈরি করে, এবং পরে নতুন পরিস্থিতিতে তা পরীক্ষা করে।
এর মাধ্যমে খেলোয়াড় একজন নিষ্ক্রিয় দর্শক থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে রূপান্তরিত হয়, চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে, এবং শিক্ষার কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
গবেষণার মূল ফলাফল: সহমর্মিতা থেকে সামাজিক ক্ষমতায়ন পর্যন্ত
২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই গবেষণায় প্রায় ৪০০টি গেম বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২৪টি গেম গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে, এবং তন্মধ্যে ১০টি প্রধান নাগরিক ও সামাজিক দায়িত্বের উপাদান নির্ধারণ করা হয়েছে, যা তিন স্তরের থিম্যাটিক বিশ্লেষণ ও কোডিং পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত।
এই দশটি উপাদান হলো—
▫️সামাজিক সচেতনতা: দারিদ্র্য, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক সংকট সম্পর্কে বোঝাপড়া তৈরি করা।
▫️সহমর্মিতা: খেলোয়াড়কে এমন পরিস্থিতিতে রাখা যেখানে সে অন্যের অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারে।
▫️নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে অঙ্গীকার।
▫️সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ (ভার্চুয়াল বা বাস্তব)।
▫️আচরণে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা।
▫️ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা।
▫️পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই চেতনা।
▫️সহযোগিতা, দলগত মনোভাব ও সংলাপ।
▫️সামাজিক ক্ষতি প্রতিরোধ।
▫️অন্যদের ক্ষমতায়ন ও সহায়তা।
শিক্ষার তিনটি কার্যকর কৌশল গেমে
১. ইন্টারঅ্যাকটিভ গল্প (Interactive Narrative): যে গেমগুলোতে খেলোয়াড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে এবং তার ফলাফল সে অনুভব করে, সেগুলো দায়িত্ববোধ ও পরিণতির ধারণা শেখাতে অধিক কার্যকর।
২. গভীর গল্পনির্মাণ ও চরিত্রায়ণ (Storytelling & Character Development): আবেগপূর্ণ কাহিনি ও প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে খেলোয়াড়ের চিন্তাশক্তি ও অনুভূতি সক্রিয় হয়, যা নৈতিক শিক্ষার শক্তিশালী বাহক।
৩.রোল-প্লেয়িং ধারা (RPG): চরিত্র বিকাশ, বিকল্প সিদ্ধান্ত ও জটিল মানবিক সম্পর্কের সুযোগ থাকায় এই গেমধারা শিক্ষণ ও আত্মবিশ্লেষণের উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র তৈরি করে।
সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ গবেষণার দিকনির্দেশ
সেমিনারের আলোচনায় ড. মহিয়া বারাকাত এই গবেষণাকে প্রশংসা করে বলেন, এটি ভিডিও গেমকে শুধুমাত্র “ভালো” বা “খারাপ” এই দ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একটি জটিল ও বহুস্তরীয় সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে বিশ্লেষণ করেছে, যা একে বিশেষভাবে মূল্যবান করে তুলেছে।
তিনি কয়েকটি প্রস্তাবও দেন
নমুনা নির্বাচনের স্বচ্ছতা: ৪০০ গেম থেকে কেন ২৪টি বেছে নেওয়া হয়েছে, সেই মানদণ্ড স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
ধারণামূলক মডেল উপস্থাপন: গবেষণার লক্ষ্য যেহেতু একটি মডেল তৈরি করা, তাই ধারণাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রদর্শনকারী একটি ভিজ্যুয়াল চার্ট থাকা উচিত।
”প্রতিনিধিত্ব” (Representation) শব্দের ব্যাখ্যা: এটি কি বাস্তবতার প্রতিফলন, নাকি নতুন বাস্তব নির্মাণ—তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা দরকার।
ড. বারাকাত আরও বলেন, নির্মাতার উদ্দেশ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যাও গেমের অর্থকে পুনর্নির্মাণ করে।
তিনি উদাহরণ দেন—এক গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংস গেম GTA-তে কিছু খেলোয়াড় তাদের নিজস্ব জীবনানুভূতির কারণে নৈতিক ও সহায়ক আচরণ বেছে নিত। এটি প্রমাণ করে যে, খেলোয়াড়ের অর্থগঠন প্রায়ই নির্মাতার উদ্দেশ্য থেকে ভিন্ন হতে পারে।
ইরানি গেম শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও “গেম”–এর শিল্পরূপ
ড. রাজিজাদে ব্যাখ্যা করেন, এই গবেষণায় মূলত বিদেশি গেম বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কারণ ইরানি গেম শিল্প এখনো প্রধানত মোবাইল ও কেজুয়াল গেমে সীমাবদ্ধ, এবং জটিল গল্পভিত্তিক রোল-প্লেয়িং বা কনসোল গেমে উন্নয়ন তুলনামূলকভাবে কম।
তিনি আরও বলেন, “ভিডিও গেম এক স্বতন্ত্র ও সমন্বিত শিল্পরূপ; এটি চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও চিত্রকলার মতো শিল্পকে একত্র করেছে এবং ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ যোগ করে নিজেকে এক অনন্য ও জীবন্ত শিল্পমাধ্যমে পরিণত করেছে।”
আপনার কমেন্ট