হাওজা নিউজ এজেন্সি: পবিত্র কোরআন ও আহলে বাইত (আ.)–এর শিক্ষায় ধারাবাহিকভাবে যে গুণটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে—তা হলো সবর। এটি মুমিনের জীবনে পরীক্ষার মুহূর্তে স্থিরতা, পাপে সংযম, ইবাদতে অবিচলতা এবং নিয়তির প্রতি সন্তুষ্টির সামগ্রিক রূপ। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর দৃষ্টিতে যেমন, তেমনি সমগ্র ইসলামি আধ্যাত্মিকতায়—সবর হলো ঈমানের প্রাণ; এটি ছাড়া ঈমান অসম্পূর্ণ ও অচল।
“ধৈর্য ছাড়া ঈমান টিকে থাকে না” — আহলে বাইত (আ.)–এর শিক্ষা
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন, “সবর ঈমানের জন্য সেই রকম অপরিহার্য, যেমন মাথা শরীরের জন্য। মাথা ছাড়া শরীর টিকে থাকে না—তেমনি ধৈর্যহীন হলে ঈমানও বিলুপ্ত হয়ে যায়।” [আল-কাফি]
এই বাস্তবতাকে আরও ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম আলী (আ.)। ঈমানের চার ভিত্তি তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন—
১. সবর (ধৈর্য)
২. ইয়াকিন (দৃঢ় বিশ্বাস)
৩. আদল (ন্যায়)
৪. জিহাদ (সংগ্রাম)
ইমাম আলী (আ.) ধৈর্যের চার উপাদানও ব্যাখ্যা করেছেন—
– জান্নাতের আকাঙ্ক্ষা,
– জাহান্নামের ভয়,
– ইবাদতে নিষ্ঠা,
– এবং মৃত্যুর প্রস্তুতি।
মানুষ যখন পরকালের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন দুনিয়ার প্রলোভন ও কষ্ট তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
সবর: সংজ্ঞা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
ইসলামি পণ্ডিতরা ধৈর্যের ব্যাখ্যায় গভীর আধ্যাত্মিক মাত্রা তুলে ধরেছেন।
নাসিরুদ্দিন তূসী বলেন, “অপ্রিয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে নিজের অন্তরকে অস্থিরতা থেকে বিরত রাখতে পারাই সাবর।”
গুনিয়ানারফ খাজা আব্দুল্লাহ আনসারি বলেন, “অন্তরের গভীর দুঃখ নিয়ে অভিযোগ না করা— সেটাই প্রকৃত সাবর।”
ধৈর্য মানে শুধু চুপ থাকা নয়, বরং নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সচেতন সাধনা।
সবরের ধরন ও স্তরসমূহ
ইসলামি ঐতিহ্যে সাবরের তিন প্রধান স্তর উল্লেখ আছে—
১. বিপদাপদে ধৈর্য: কষ্ট, ক্ষতি বা অঘটনের মুহূর্তে স্থির থাকা।
২. আনুগত্যে ধৈর্য: ইবাদতের কষ্ট, দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার পথে স্থির থাকা।
৩. পাপ থেকে বিরত থাকার ধৈর্য: সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ধৈর্য।
ইমাম আলী (আ.) আরও বলেন— “সবর দুই প্রকার—অপ্রিয় বিষয়ে ধৈর্য এবং প্রিয় বিষয়েও ধৈর্য।” কারণ কখনো কখনো আনন্দও মানুষকে বিচ্যুত করতে পারে।
সবর ও আল্লাহ–জ্ঞান (মারেফাত)–এর গভীর সম্পর্ক
সবর শুধু চরিত্র–গুণ নয়, এটি আল্লাহকে সঠিকভাবে চিনতে সাহায্যকারী একটি আধ্যাত্মিক সোপান।
১. কষ্টে অভিযোগহীনতা মারিফার পরিচায়ক: যার অন্তরে বিপদের কারণে অস্থিরতা থাকে, তার আল্লাহ–জ্ঞান অসম্পূর্ণ।
আর যে ব্যক্তি বিপদেও সন্তুষ্টি (রিদা) অর্জন করে—সে আল্লাহর নৈকট্যের বিশেষ স্তরে পৌঁছে যায়।
২. পাপ থেকে বিরত থাকার ধৈর্য গভীর ঈমানের প্রতিফলন: মানুষ যখন জানে যে পরকাল তার দুনিয়ার আমলের প্রতিফলন—তখন সে কষ্টকে আল্লাহর সন্তুষ্টির অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
৩. কারবালার শিক্ষায় সবরের সর্বোচ্চ রূপ: ইমাম হুসাইন (আ.)–এর সাথীরা যে সবরের পরিচয় দিয়েছেন, তা মানবজগতের অন্যতম উচ্চতম আধ্যাত্মিক দৃষ্টান্ত।
ইমাম রিযা (আ.)–এর শিক্ষা
ইমাম রিযা (আ.) বলেন— “যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারো, করো। আর যদি তা না পারো, তবে অপছন্দনীয় পরিস্থিতিতেও সবর করো—এতে কল্যাণ আসে।” [বিহার আল-আনওয়ার]
ধৈর্যের ফলাফল: আত্মশুদ্ধি থেকে আল্লাহর–নৈকট্য পর্যন্ত
সবর মানুষকে যে ফল প্রদান করে, তার সারাংশ হলো—
১. আত্মার রূপান্তর ও শৃঙ্খলা: নিয়মিত ধৈর্য অনুশীলনের মাধ্যমে নফস পরিশুদ্ধ হয় এবং মানুষ উচ্চতর আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে।
২. সংকটে স্থিরতা ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি: আর্থিক ক্ষতি, মৃত্যু বা বিপর্যয়ে অভিযোগ না করে সাবর করা—মুমিনকে সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করে।
৩. তকওয়া, আল্লাহ–মহব্বত ও রিদার পথ:
• পাপ থেকে সবর→ তকওয়া
• আনুগত্যে সবর→ আল্লাহর নৈকট্য
• বিপদে সাবর→ নিয়তির প্রতি সন্তুষ্টি (রিদা)
সবরের উচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরসমূহ
সবর চারটি আধ্যাত্মিক স্তরে বিভক্ত:
১. সবর ফি-ল্লাহ (আল্লাহর জন্য): নফসকে পবিত্র করতে নিজস্ব ত্রুটি, কামনা ও দোষ-ত্রুটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
২. সবর মা’আল্লাহ (আল্লাহর সাথে): ইবাদতের পথে আল্লাহর নৈকট্যের আলো অনুভব করা এবং অহংকার–মুক্ত থাকা।
৩. সবর ‘আনিল্লাহ (আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্নতায় ধৈর্য): আল্লাহর গভীর প্রেম অনুভবের পর দুনিয়ায় ফিরে আসার বেদনাকে সহ্য করা।
ইমাম আলী (আ.) দোয়া কুমাইলে বলেন— “হে আল্লাহ! যদি তোমার শাস্তি সহ্য করতে পারি, তবে তোমার থেকে বিচ্ছিন্নতা কীভাবে সহ্য করব?”
৪. সবর বি-ল্লাহ (আল্লাহর দ্বারা, আল্লাহর শক্তিতে ধৈর্য): আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার শেষ স্তর—যেখানে মানুষ আল্লাহর গুণাবলিকে নিজের চরিত্রে ধারণ করে।
সবর এমন এক সামগ্রিক গুণ, যা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ক্ষেত্রেই মুমিনকে সফলতার পথে পরিচালিত করে। এটি মুমিনের আত্মাকে স্থিতিশীল করে, চিন্তাকে পরিশুদ্ধ করে, আত্মাকে আলোকিত করে এবং আল্লাহ–নৈকট্যের পথে এগিয়ে দেয়।
পবিত্র কোরআন যেমন ঘোষণা করে— “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।” (৮:৪৬)
সুতরাং, সবর শুধু একটি নৈতিক নির্দেশনা নয়; এটি ঈমানের প্রাণ, আত্মশুদ্ধির পথ, এবং আল্লাহ–নৈকট্যের চাবিকাঠি।
আপনার কমেন্ট