শনিবার ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ - ০৬:৫৬
বুদ্ধি সম্পর্কিত একটি হাদিসের ব্যাখ্যা

ইসলামের ইতিহাসে বুদ্ধি বা আকলকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। “আকল” শুধু চিন্তার ক্ষমতা নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রদত্ত নূর, যা মানুষকে ভালো-মন্দ বুঝতে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব সূত্রে বর্ণিত আছে, যে ইমাম আবু জাফর (আ.) বলেছেন,“যখন আল্লাহ বুদ্ধি (আক্ল) সৃষ্টি করলেন, তিনি তাকে আহ্বান করে বললেন, ‘এসো।’ বুদ্ধি এগিয়ে এল। এরপর বললেন: ‘দূরে যাও।’ সে দূরে সরে গেল। তারপর আল্লাহ বললেন, ‘আমার সম্মান ও মহিমার শপথ, আমি তোমার চেয়ে অধিক প্রিয় কিছু সৃষ্টি করিনি। আমি কেবল আমার প্রিয় বান্দাদের মধ্যেই তোমাকে পরিপূর্ণ করি। আমার নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা তোমাকে উদ্দেশ্য করেই—এবং তোমার মাধ্যমেই আমি শাস্তি দেব কিংবা পুরস্কৃত করব।’”

একই বক্তব্য ইমাম আল-রেজা (আ.) থেকেও আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, “যে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি বুদ্ধিহীন, তার কোনো মূল্য নেই।”

এ কথা শুনে একজন শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “মাওলা! আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা ধর্মের দিক থেকে নির্ভুল, কিন্তু আপনার বর্ণিত বুদ্ধি তাদের নেই।”

ইমাম বললেন, “তারা সেই শ্রেণির মানুষ নন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ কথা বলেছেন।” এরপর ইমাম পূর্বোক্ত হাদিসের একই বিবরণ পুনরায় উল্লেখ করেন।

বুদ্ধি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত
শব্দার্থবিদ, দার্শনিক ও বিভিন্ন পণ্ডিতরা “বুদ্ধি (আকল)” শব্দটি নানা অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

১. বুদ্ধি—চিরন্তন এক সত্তা: কিছু দার্শনিক মনে করেন বুদ্ধি একটি চিরস্থায়ী সত্তা, যা বস্তুগত প্রভাব থেকে মুক্ত। হাদিসের আলোকে এই মত দুর্বল, কারণ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “যখন আল্লাহ বুদ্ধি সৃষ্টি করলেন…” এতে বোঝা যায়—বুদ্ধি সৃষ্টি, চিরন্তন নয়।

২. বুদ্ধি—মানুষের চিন্তাশক্তি: কিছু যুক্তিবিদ মনে করেন, বুদ্ধি হলো মানুষের চিন্তার সেই ক্ষমতা যা তাকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে। কিন্তু এটি হাদিসে বর্ণিত বুদ্ধির আধ্যাত্মিক উৎসকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। হাদিসে বুদ্ধি হলো উচ্চতর আধ্যাত্মিক বাস্তবতার প্রতিফলন, শুধুমাত্র বৌদ্ধিক বিকাশ নয়।

৩. বুদ্ধি—সমাজ সংগঠনের ক্ষমতা: কিছু মতানুসারে বুদ্ধি সামাজিক শৃঙ্খলা গঠন করে। তবে এটিও আংশিক, কারণ হাদিস বুদ্ধিকে শুধুমাত্র সামাজিক ব্যবস্থার আলোচনার বাইরে তুলে ধরে।

৪. বুদ্ধি ও আত্মা (নফস) আলাদা: আত্মা পরিবর্তনশীল, ব্যক্তিভেদে ভিন্ন; সৃষ্টি, মৃত্যু ও পুনরুত্থান ঘটে। বুদ্ধি—হাদিস অনুযায়ী—একটি একক সৃষ্টি, যা মানুষের মাঝে বিভিন্ন মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। অতএব বুদ্ধিকে আত্মার সমার্থক বলা সঠিক নয়।

৫. বুদ্ধি—আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অন্তরায়: কিছু সুফি মতে বুদ্ধি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির পথে বাধা। কিন্তু হাদিস দেখায়: প্রকৃত বুদ্ধি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম—বাধা নয়।

৬. বুদ্ধি—সৎ-অসৎ বিচারশক্তি। আরও দু’টি ব্যাখ্যা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য: বুদ্ধি ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা; অথবা সৎ কাজে প্রেরণার শক্তি। হাদিসের আলোকে—উভয় ব্যাখ্যাতেই সত্যের অংশ রয়েছে।

আল্লাহর আনুগত্যের মূল মাধ্যম—বুদ্ধি 

হাদিস অনুসারে—

• বুদ্ধিই ইবাদত ও আনুগত্যের ভিত্তি
• আদেশ-নিষেধ বুদ্ধির কাছে পৌঁছে
• শাস্তি ও পুরস্কার বুদ্ধির আলোকে নির্ধারিত হয়।

হাদিসে “এসো” ও “দূরে যাও”—এসব রূপক, আমাদের বোঝার সুবিধার্থে।
এসব কোনো বাস্তব স্থান-কালগত গতি নয়; বরং উচ্চতর আধ্যাত্মিক বাস্তবতা

যে ব্যক্তি বুদ্ধিকে পূর্ণরূপে ব্যবহার করে, সে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর আনুগত্যে নিমগ্ন হয় এবং তার দৃষ্টি কেবল আল্লাহমুখী হয়। এটাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আকলের সত্য রূপ; এরপর তাঁর আহলুল বায়তের।

ইসমত (নিষ্পাপতা): দুই প্রকার

১. শরীয়তগত ইসমত: নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখা, গুনাহ থেকে বিরত থাকা, ফরজ-ওয়াজিব আদায় করা, এবং নেক কাজে সচেষ্ট হওয়া—এ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়।

২. অস্তিত্বগত ইসমত: যারা বুদ্ধির পূর্ণ প্রতিফলন অর্জন করেন—তারা আল্লাহর নামসমূহ উপলব্ধির এমন স্তরে পৌঁছান যে, গুনাহ থেকে তাদের বিরত থাকতে প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না—কারণ তারা স্বভাবতই আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন।

এটাই আহলুল বায়তের আধ্যাত্মিক সত্য—এটি রক্তসম্পর্কের বিষয় নয়; আধ্যাত্মিক যোগ্যতার বিষয়।

তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সালমান আমাদের আহলুল বায়তের একজন।”

কুরআনেও হযরত ইব্রাহিম (আ.)–এর স্ত্রী সারাহকে “আহলুল বায়ত” বলা হয়েছে (হুদ:৭৩)।

ইসমতের স্তরভেদ আছে—
সর্বোচ্চ স্তর:
•রাসূলুল্লাহ (সা.)
•ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)
•বারো ইমাম

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha