বুধবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ২০:৫৬
নবুওয়াতের ঘরের আলো: ইসলামের প্রথম দিনের সংগ্রামে ফাতিমা (সা.আ.)

ইসলামের প্রথম দিনের ভয়াবহ নির্যাতন, বয়কট ও সংগ্রামের অন্ধকার সময়ে নবুওয়াতের ঘরে যে আলো অবিচ্ছিন্নভাবে জ্বলেছিল, তার অন্যতম উৎস ছিলেন হজরত ফাতিমা (সা.আ.)। শৈশবেই বাবার সংগ্রাম, উম্মতের দুঃখ ও সমাজের প্রতিকূলতা প্রত্যক্ষ করেও তিনি যে সাহস, ধৈর্য ও নৈতিক শক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন—তা শুধু নবী পরিবারের ভিত্তিকেই শক্তিশালী করেনি, বরং ইসলামের প্রাথমিক অগ্রযাত্রাকেও অদৃশ্যভাবে ছায়া দিয়ে রক্ষা করেছে। ইসলামের ইতিহাসের সেই সংকটময় সময়ে তাঁর নীরব কিন্তু প্রভাবশালী উপস্থিতিই আজও প্রতিধ্বনিত হয় “নবুওয়াতের ঘরের আলো” নামে।

বিশেষ সাক্ষাত্কার:

হাওজা নিউজ এজেন্সি'র সঙ্গে এই বিষয়ে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন তাকি আব্বাস রিজভী (আহলে বাইত ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি, মোবাল্লিগ ও গবেষক); পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, তাকি আব্বাস রিজভী সাহেব, আপনাকে স্বাগতম। আজ আমরা আলোচনা করব—ইসলামের প্রথম যুগের সংগ্রামে হজরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর ভূমিকা নিয়ে। প্রথমেই জানতে চাই, কেন তাঁকে “নবুওয়াতের ঘরের আলো” বলা হয়?

তাকি আব্বাস রিজভী:

ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আপনাকেও ধন্যবাদ। তাঁকে “নবুওয়াতের ঘরের আলো” বলা হয় কারণ তিনি ছিলেন সেই ঘরের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে অবতীর্ণ হয়েছে কোরআনের ওহি, এবং যেখানে গড়ে ওঠেছিল মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী নৈতিক বিপ্লব।
ফাতিমা (সা.আ.)-এর অস্তিত্বই ছিল নবুওয়াতের বার্তার ধারাবাহিকতার প্রতীক। তাঁর চরিত্র, ত্যাগ, সহনশীলতা এবং নৈতিক দৃঢ়তা নবুওয়াতের ঘরকে আলোকিত করেছে। তিনি শুধু নবী পরিবারের সদস্য ছিলেন না—তিনি ছিলেন সেই আলোর উত্তরাধিকারী, যার মাধ্যমে নবুওয়াতের শিক্ষা পরবর্তী যুগে পৌঁছেছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

ইসলামের প্রথম দিনের সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই কঠিন সময়ে ফাতিমা (সা.আ.)-এর ভূমিকা কী ছিল?

তাকি আব্বাস রিজভী:

ইসলামের প্রথম যুগে পরিস্থিতি ছিল ভয়ংকর: নির্যাতন, বয়কট, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নকরণ, আর্থিক কষ্ট—সব কিছুই একসাথে।
ফাতিমা (সা.আ.) খুব ছোট বয়সে এসব দেখেছেন, তবু তাঁর অবস্থান ছিল অসাধারণভাবে পরিণত। তাঁর ভূমিকা তিনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়—

১. মানসিক শক্তির উৎস:
নবী (সা.) যখন অপমানিত ও আহত হয়ে ঘরে ফিরতেন, ফাতিমা (সা.আ.) ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। তাঁর কোমল হাতে তিনি পিতাকে সেবা করতেন এবং মানসিকভাবে শক্তি দিতেন। এ কারণেই তাঁকে “উম্মে আবিহা”—বাবার মা—উপাধি দেওয়া হয়।

২. সাহস ও প্রত্যয়:
মক্কার শত্রুতা, বয়কট, হুমকি—এসবের মাঝেও তিনি কখনো ভেঙে পড়েননি। এই মানসিক দৃঢ়তা পরবর্তী যুগের নারীদের জন্য এক মহৎ উদাহরণ।

৩. নবুওয়াতের বার্তার রক্ষক:
তাঁর চরিত্র ও আচরণ ছিল নবীর বার্তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ফলে ইসলামবিরোধী শক্তিরা যখন নবীকে লক্ষ্য করত, তখন ফাতিমা (সা.আ.)-এর প্রভাব ছিল বার্তা রক্ষার একটি শক্তিশালী ভিত্তি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

অনেকে মনে করেন, ফাতিমা (সা.আ.)-এর ভূমিকা শুধু পারিবারিক সেবাযত্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি কি সঠিক ধারণা?

তাকি আব্বাস রিজভী:

না, এটি একটি অসম্পূর্ণ ধারণা। অবশ্যই তিনি ছিলেন আদর্শ কন্যা, কিন্তু তাঁর ভূমিকা সেখানে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন—

একজন সক্রিয় সামাজিক ব্যক্তিত্ব,

একজন সাহসী মানবাধিকার সুরক্ষক,

একজন আধ্যাত্মিক নেতা,

এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত।


ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে নারীদের ওপর যে অতিরিক্ত চাপ ছিল, তিনি সাহসের সঙ্গে সেই চাপ মোকাবিলা করেছেন এবং নারীর আত্মমর্যাদার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

মক্কার নির্যাতনের সময় ফাতিমা (সা.আ.)-এর ছোটবেলায় যে দৃশ্যগুলো তিনি দেখেছেন—এসব কি তাঁর ভবিষ্যৎ চরিত্র গঠনে প্রভাব ফেলেছিল?

তাকি আব্বাস রিজভী:

অবশ্যই। তিনি দেখেছেন—

তাঁর বাবা প্রহৃত হয়ে ফিরছেন,

মুসলমানরা নির্দয়ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে,

শবে আবু তালিবের কঠোর বয়কট,

ক্ষুধা ও অভাব,

সামাজিক বিদ্বেষ।

এমন পরিবেশ মানুষকে হয় দুর্বল করে, নয়তো শক্তিশালী করে। ফাতিমা (সা.আ.)-এর ক্ষেত্রে এই পরিবেশ তাঁর আত্মিক শক্তি দ্বিগুণ করেছে। তিনি ছোট থেকেই শিখেছিলেন—সত্যের পথে দাঁড়াতে কষ্ট আসবেই, কিন্তু ন্যায়কে ত্যাগ করা যাবে না।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

ইসলামের ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, প্রথম যুগের সংগ্রামে ফাতিমা (সা.আ.) ছিলেন “অদৃশ্য কিন্তু কেন্দ্রীয় শক্তি।” আপনি কি একমত?

তাকি আব্বাস রিজভী:

হ্যাঁ, সম্পূর্ণ একমত। তাঁর ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না, কারণ তিনি তখন খুবই অল্পবয়সী এবং নারীদের প্রকাশ্য ভূমিকা সে সময় সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু তিনি ছিলেন সেই নৈতিক শক্তি—যা নবীর ঘরকে টিকিয়ে রেখেছিল। তাঁর দৃঢ় মানসিকতা, তাঁর দোয়া, তাঁর সেবা—সবই ইসলামের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে।
ইতিহাসে তাঁর অবদান অনেকটা আলোকিত সুতো—যা পুরো চিত্রকে ধরে রেখেছে, কিন্তু সামনে থেকে চোখে পড়ে না।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

ফাতিমা (সা.আ.)-এর এই সংগ্রাম আজকের মুসলিম সমাজকে কী শিক্ষা দেয়?

তাকি আব্বাস রিজভী:

আমি বলব—অত্যন্ত যুগোপযোগী তিনটি শিক্ষা—

১. সত্যের পক্ষে কঠিন সময়েও দৃঢ় থাকা:
অন্যায় বা চাপের মুখেও মানসিক সাহস না হারানো।

২. পারিবারিক সম্পর্কের শক্তি:
পরিবার যদি নৈতিক আলোর ঘর হয়, সমাজে পরিবর্তন সহজ হয়।

৩. নারীর ভূমিকার মর্যাদা:
ফাতিমা (সা.আ.) প্রমাণ করেছেন—নারী শুধু ঘরে নয়, সমাজের নৈতিক ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

ইসলামের প্রথম যুগের সংগ্রামে তাঁর অবদানের সবচেয়ে বড় দিকটি কোনটি বলে আপনি মনে করেন?

তাকি আব্বাস রিজভী:

সবচেয়ে বড় দিক হলো—তিনি নবুওয়াতের বার্তার নৈতিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছিলেন।
তিনি ছিলেন সেই জীবন্ত আদর্শ, যাকে দেখে মানুষ বুঝত—ইসলাম কী চায়।
এমনকি অমুসলিমরাও তাঁর আচরণ দেখে প্রভাবিত হয়েছে।
নবীর ঘরে যে আলো জ্বালানো হয়েছিল, সেই আলোকে তিনি নিজের জীবনের মাধ্যমে রক্ষা করেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

শেষে, আমাদের পাঠকদের জন্য আপনি কী বার্তা রেখে যেতে চান?

তাকি আব্বাস রিজভী:

আমার বার্তা হলো—
আমরা যদি ইসলামের সত্যিকারের শক্তি বুঝতে চাই, তবে নবুওয়াতের ঘরকে বুঝতে হবে; আর নবুওয়াতের ঘর বুঝতে চাইলে ফাতিমা (সা.আ.)-কে জানতে হবে।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—

সংকটকে সাহস দিয়ে মোকাবিলা করতে,

কঠিন সময়েও মানবিক থাকতে,

এবং ন্যায় ও সত্যের পতাকা কখনো নিচে না ফেলতে।

তাঁর জীবন আজও আলো ছড়ায়, কারণ তিনি ছিলেন আলোর ঘরের আলো।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:

তাকি আব্বাস রিজভী সাহেব, আপনার মূল্যবান ব্যাখ্যা ও গভীর বিশ্লেষণের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আজকের আলোচনা আমাদের নতুনভাবে ইতিহাস ও নৈতিকতার দিকে তাকাতে সাহায্য করল।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha

Comments

  • الطمش لشکری پوری IN ২১:২৯ - ২০২৫/১২/১০
    "এই সাক্ষাৎকারটি খুবই উত্তম, ঐতিহাসিক এবং তথ্যপূর্ণ। আমি আপনার পুরো টিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।"
    Site Answer:

    ধন্যবাদ

  • altamash IN ২১:৩১ - ২০২৫/১২/১০
    "এই সাক্ষাৎকারটি খুবই উত্তম, ঐতিহাসিক এবং তথ্যপূর্ণ। আমি আপনার পুরো টিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।"
    Site Answer:

    ধন্যবাদ