হাওজা নিউজ এজেন্সি: নতুন আর্কিটেকচার কি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পুনর্গঠন, নাকি কঠিন সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষমতা সংহত করার প্রয়াস— এ প্রশ্ন এখন ইসরায়েলি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে।
২০২৩ থেকে ২০২৫—এই তিন বছর ইসরায়েলের জন্য কেবল সামরিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময়গুলোর একটি। গাজা যুদ্ধের ব্যর্থতা, অভ্যন্তরীণ তদন্তের চাপ, দুর্নীতির চারটি মামলার ঝড় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হঠাৎ পরপর তিনটি শীর্ষ নিরাপত্তা নিয়োগ সম্পন্ন করেন।
বাহ্যিকভাবে এগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হলেও, গভীরে গেলে বোঝা যায়—ইসরায়েলের নিরাপত্তা কাঠামোতে এটি এক মৌলিক পুনর্গঠনের সূচনা, যা রাজনৈতিক বেঁচে থাকার হিসাব–নিকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
১. সংকটের মুখে নেতানিয়াহুর লক্ষ্য: ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন
তুফানুল-আকসা অপারেশনের পর ইসরায়েলের গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ‘ব্যর্থ’, ‘অসংগঠিত’ এবং ‘রাজনৈতিক প্রভাবাধীন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—
তিনি যুদ্ধের আগাম সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিলেন এবং যুদ্ধ–পরবর্তী বিশৃঙ্খলায় নেতৃত্বহীনতা দেখিয়েছিলেন।
একই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির চারটি মামলার বিচার আবারও গতি পাচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু যে তিনটি নিয়োগ দিলেন, তা বিশ্লেষকদের কাছে এক ধরনের রক্ষাকবচ নির্মাণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে—যেখানে স্বাধীন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে তিনি গড়ে তুলছেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনুগত্যের বলয়।
২. শিন বেত: নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার স্বাধীনতা ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেতানিয়াহু শিন বেতের প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন মেজর জেনারেল ডেভিড জিনি–কে। এই সিদ্ধান্তে বিতর্ক সৃষ্টি হয় কারণ—
• যিনি একজন সামরিক কর্মকর্তা;
• গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা নেই;
• এবং তিনি নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ব্লকের প্রতি সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
সুপ্রিম কোর্ট পূর্ববর্তী প্রধান রোনেন বার–কে অপসারণকে অবৈধ ঘোষণা করলেও, নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করে দেন।
শিন বেতের সাবেক কর্মকর্তারা সতর্ক করেন—
এটি গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনৈতিক যন্ত্রে পরিণত করার প্রথম ধাপ এবং এর ফল হবে পেশাদার মূল্যায়নের বদলে রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
৩. সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ: সামরিক কাঠামোকে রাজনৈতিক ছায়ায় আনা
২০২৫ সালের গ্রীষ্মে জেনারেল ইয়াল জমির’কে চিফ অফ স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জমির বহু বছর ধরে নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা এবং লিকুদ দলের বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।
এই নিয়োগের গুরুত্ব হলো— ইসরায়েলের ইতিহাসে প্রথমবার সেনাবাহিনী, শিন বেত এবং মোসাদের মতো তিনটি মূল নিরাপত্তা স্তম্ভের মাথায় নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বসেছেন।
সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান আমোস ইয়াদলিন সতর্ক করে বলেছেন— এটি “নজিরবিহীন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন”, যা সামরিক সিদ্ধান্তগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করে তুলবে এবং চেক–অ্যান্ড–ব্যালেন্স দুর্বল করবে।
সাধারণত এ ধরনের নিয়োগ যাচাই করতে যে স্বাধীন কমিটি থাকে, এবার সেটিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে কেবল আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
৪. মোসাদ প্রধান: ব্যক্তিগত আনুগত্যে ভরসা, পেশাদারিত্বের দ্বার সংকুচিত
২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘোষিত হয়— মোসাদের নতুন প্রধান হচ্ছেন রোমান গাফমান।
গাফমানের বৈশিষ্ট্য:
• তিনি একজন সামরিক কর্মকর্তা,
• গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা নেই,
• নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন,
• এবং ধর্মীয়–জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জন্য পরিচিত।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম Haaretz–এর মতে, এটি পেশাদার যোগ্যতার নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার।
সাধারণত মোসাদের প্রধান নিয়োগ দেওয়া হয় এমন কাউকে, যিনি গভীর কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা দক্ষতার অধিকারী। কিন্তু এবার এমন একজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে যার প্রধান শক্তি—প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অপরিবর্তিত আনুগত্য।
এতে স্পষ্ট— ইসরায়েলের বিদেশি অভিযান, বিশেষ করে গোপন অপারেশনগুলোও এখন নেতানিয়াহুর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে যাবে।
৫. রাজনৈতিক বেঁচে থাকার লড়াই: নেতানিয়াহুর কৌশল কি সফল হবে?
বিশ্লেষকদের মতে, তিনটি নিয়োগ একসঙ্গে দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করে—
ক. ক্ষমতার পুনর্গঠন:
নিরাপত্তা সিদ্ধান্তগুলো এখন আর বহুস্তরীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আসবে না;
এসবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন একজন ব্যক্তি—প্রধানমন্ত্রী।
খ. ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার লড়াই: তদন্ত কমিটি, দুর্নীতি মামলার বিপদ এবং গাজা যুদ্ধের দায়—
সবকিছুর মোকাবিলায় এই নিরাপত্তা বলয় নেতানিয়াহুর জন্য একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের ভাষায়— “এটি এমন এক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টা, যেখানে প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যই মুখ্য।”
কোন দিকে যাচ্ছে ইসরায়েল?
শিন বেত, মোসাদ এবং সেনাবাহিনী— এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ইসরায়েলের নিরাপত্তা স্থাপত্যের ভিত্তি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক নিয়োগগুলো সেই ভিত্তিকে নড়িয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েল কি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিরাপত্তা মডেলের দিকে যাচ্ছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অফিসই হবে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত কেন্দ্র? নাকি এটি কেবল নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষার জরুরি কৌশল— যা সংকট কেটে গেলে আবার পরিবর্তিত হবে?
উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—
ইসরায়েলের নিরাপত্তা কাঠামোতে যে পুনর্গঠন শুরু হয়েছে, তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে শুধু ইসরায়েলের ভেতরেই নয়,
পুরো অঞ্চলে পড়তে পারে।
আপনার কমেন্ট