হাওজা নিউজ এজেন্সি: কখনও আমরা এমন লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যারা অসংখ্য সৎকর্ম করে। তারা হাসপাতাল নির্মাণ করে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, দরিদ্রদের সাহায্য করে, কিন্তু বলে— “আমি শুধু আল্লাহকে মানি, নবী এবং আহলে বাইতকে নয়।” অথবা কেউ কেউ বলে:
“আমি ধর্মকেই মানি না, শুধু মানবপ্রেমে বিশ্বাস করি।”
প্রশ্ন হলো— এমন ব্যক্তি কি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সফলতা বা প্রতিদান লাভ করবে?
প্রধান আলোচনায় প্রবেশের আগে জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন যে, আল্লাহ রহমান ও রহিম। তিনি কোনো সৎকর্মকে পুরস্কারহীন রাখেন না। এমনকি যদি কেউ ধর্মহীন হয়েও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাকে এই দুনিয়াতেই— যেমন ধনসম্পদ, সুনাম, স্বাস্থ্য ও মানসিক শান্তির মাধ্যমে পুরস্কার দেন। কিন্তু মূল বিষয় হলো, এই দুনিয়াবী পুরস্কারই কি সম্পূর্ণ কাহিনি, নাকি এর চেয়েও আরও কিছু আছে?
যখন কেউ বলে, “আমি শুধু আল্লাহকে মানি, কিন্তু কুরআন, নবী এবং ইমামদের মানি না”, তখন প্রথম প্রশ্ন হলো— আপনি কোন পথে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছেন? কীভাবে বুঝলেন যে সৃষ্টিকর্তা এক? কীভাবে মূর্তিপূজা বা খ্রিস্টান ত্রিত্ববাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে তাওহীদে (একত্ববাদে) পৌঁছেছেন?
উত্তর স্পষ্ট— বুদ্ধির মাধ্যমে। কারণ আল্লাহকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না; তাঁকে চেনার একমাত্র উপায় হলো বুদ্ধি (আকল)। কিন্তু সেই বুদ্ধিই, যা আল্লাহর একত্বকে দেখিয়েছে, আরও একটি কথা বলে— মানুষের জীবনে বুদ্ধির পাশাপাশি ধর্ম ও ওহীর প্রয়োজন রয়েছে। কেননা বুদ্ধির কার্যক্ষেত্র সীমিত। বুদ্ধি মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের সীমার মধ্যে কাজ করে, কিন্তু ওহীর পরিধি মানুষের জ্ঞানের বাইরে।
কুরআন বলে—
“كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ … وَ يُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ”
(সূরা বাকারা: ১৫১)
অর্থাৎ, “যেমন আমরা তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই একজন রাসূল প্রেরণ করেছি… যাতে তিনি তোমাদের এমন বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না।”
যদি ওহী না থাকত, তাহলে বহু জ্ঞান চিরকাল অজানা থেকে যেত। মানুষ জানত না—জগতের শুরু ও শেষ কী, কেন সৃষ্টি হয়েছে, কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাবে। ধর্মই এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
এখন প্রশ্ন হলো— যদি কেউ একটি ক্ষেত্রে (যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব) বুদ্ধির অনুসরণ করে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে (যেমন নবুয়ত) সেই বুদ্ধির নির্দেশ অমান্য করে, তাহলে কি তা যুক্তিসঙ্গত? কেন বুদ্ধি এক জায়গায় গ্রহণযোগ্য, আর অন্য জায়গায় অগ্রহণযোগ্য হবে?
যদি ধর্ম না থাকে, তাহলে আল্লাহর বিশ্বাসের উপকারিতা কী? ধরুন, কেউ শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু নবী, ধর্ম, আখিরাত ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে না—এই বিশ্বাস তার কোন সমস্যা সমাধান করে? যদি আখিরাতে বিশ্বাস না থাকে, তাহলে আল্লাহর অস্তিত্ব থাকা বা না থাকার মধ্যে বাস্তব পার্থক্যই বা কী?
মনে হয়, এ ধরনের বিশ্বাস অনেক সময় “কাফির” বা “আল্লাহহীন” পরিচয় থেকে পালানোর একটি কৌশল। এটি ধর্মীয় দায়িত্ব এড়ানোর একটি পথ— যাতে ধর্ম মানতে না হয়, অথচ সম্পূর্ণ অবিশ্বাসীও বলা না যায়। কিন্তু এমন এক আল্লাহর ধারণা, যিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিজেদের হালে ছেড়ে দিয়েছেন, তা প্রজ্ঞাময় ও দয়ালু আল্লাহর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ঈমানহীন ব্যক্সতির ৎকর্মের পরিণতি
এখন মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। যদি কেউ হাসপাতাল নির্মাণ করে, মানুষের সেবা করে, কিন্তু আল্লাহ, নবী ও কিয়ামতে বিশ্বাস না করে—তাহলে তার পরিণতি কী?
কুরআন মাজিদের স্পষ্ট উত্তর রয়েছে—
“مَن كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَ زِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَ هُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ”
(সূরা হুদ: ১৫)
অর্থাৎ, “যারা দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করে, আমরা তাদের কর্মফল এখানেই পূর্ণরূপে দিয়ে দিই।”
এবং পরের আয়াতে বলা হয়েছে—
“أُولَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُ”
(সূরা হুদ: ১৬)
অর্থাৎ, “এদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই।”
এই আয়াতগুলো স্পষ্ট করে দেয়— কর্মের পুরস্কার নিয়ত ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। যদি কেউ দুনিয়ার উদ্দেশ্যে সৎকর্ম করে, তবে তার প্রতিদান দুনিয়াতেই পাবে। কিন্তু আখিরাতে তার কিছু থাকবে না, কারণ তার কর্ম আল্লাহর জন্য ছিল না।
ইখলাসের ভূমিকা
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলী বলেন, কিয়ামত এমন এক জগৎ যেখানে সবকিছুর প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হবে। ইসলামে কেবল সেই কর্মই গ্রহণযোগ্য, যা আল্লাহর জন্য করা হয়।
কর্মের বাহ্যিক সৌন্দর্য (হুসন-ই ফি‘লী) যথেষ্ট নয়; কর্মকারীর নিয়ত ও ঈমান (হুসন-ই ফা‘ইলী)ও প্রয়োজন। অর্থাৎ, কর্ম হতে হবে ইখলাসের সঙ্গে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ইখলাসই সেই শক্তি, যা কর্মের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে। অনেক সময় ইখলাসের সঙ্গে করা একটি ছোট কর্ম এমন মর্যাদা লাভ করে, যার পুরস্কার কেবল আল্লাহই জানেন।
আপনার কমেন্ট