সোমবার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ - ০৬:০০
তাকওয়া ও সুস্থ অন্তরই আখিরাতে মানুষের প্রকৃত সম্পদ

আয়াতুল্লাহ হাশেমী ইলিয়া তাকওয়া, নফসের পবিত্রতা ও সুস্থ-সবল অন্তরের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী ও অস্থায়ী। পরকালে মানুষের প্রকৃত পুঁজি অর্থ-সম্পদ নয়; বরং একনিষ্ঠতা ও আল্লাহভীতি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইরানের রাজধানী তেহরানের চীজারের কায়েম (আ.ফা.) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ হাশেমী ইলিয়া রোববার তালাবাদের জন্য আয়োজিত এক বিশেষ নৈতিক অধিবেশনে বলেন, দুনিয়া ও আখিরাত মুত্তাকীদের (খোদাভীরুদের) জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রকৃত রিযিকও কেবল তাদেরই দেওয়া হয়; যদিও আল্লাহ তাঁর সৎ বান্দাদের মাধ্যমেও অন্যদের রিযিক দান করেন।

তিনি আরও বলেন, ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাওফিক দেবেন যেন আমরা মুত্তাকীদের দৃষ্টান্ত হতে পারি এবং আল্লাহ মুত্তাকীদের যে রিযিক দান করেছেন, তা আমাদেরকেও দান করেন—কেবল নামে মুত্তাকি না হয়ে, বরং যেন আমাদের মধ্যে তাকওয়ার লক্ষণ ও প্রকৃত সত্তা বিরাজ করে।

মানুষের দুনিয়ার প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণের কথা উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহ হাশেমী ইলিয়া বলেন, মানুষের দুনিয়ার প্রতি আসক্তি বিস্ময়ের বিষয় নয়। ইমাম হাসান (আ.) বলেছেন, কিছু লোক দুনিয়াকে ভালোভাবেই চেনে এবং তাদের মাতৃভূমি দুনিয়া। মানুষ স্বভাবতই দুনিয়াকে ভালোবাসে এবং এতে দোষের কিছু নেই; গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানুষ বুঝতে পারা যে, দুনিয়া ও মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর উদ্দেশ্য কী। পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক বা আমোদ-প্রমোদ নয়। দুনিয়া শুধুই স্বল্পতার স্থান, আর প্রকৃত জীবন হলো আখিরাত। এ দুনিয়া কেবলমাত্র জীবনের একটি ছায়া এবং এ ছায়া খুব দ্রুতই বিলীন হয়ে যায়।

হাওজায়ে ইলমিয়ার এই বিশিষ্ট শিক্ষক আরও বলেন, আপনি যদি প্রতিটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেন, তাতে বেদনা ও যাতনা দেখতে পাবেন, কারণ দুনিয়া অপ্রতুলতা ও কষ্টের স্থান। মানুষকে এই স্বল্পতার মধ্যেই তার জীবনকালকে কাজে লাগাতে হবে। মুত্তাকীদের লক্ষ্য দুনিয়া নয়, তবে এটা নয় যে তারা দুনিয়ার ব্যবহারই করবে না; বরং তারা দুনিয়াকে মাধ্যম হিসেবে জানে। আল্লাহ এই দেহকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যাতে এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়, তাই নেয়ামতের সঠিক ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু অন্তরকে এর প্রতি আসক্ত করা যাবে না।

আয়াতুল্লাহ হাশেমী ইলিয়া বলেন, দুনিয়ার সাথে আখিরাতের অনুপাত একটি সরিষার দানার সাথে মহাসাগরের মতো। দুনিয়া ক্ষুদ্র, তুচ্ছ ও ধ্বংসশীল। কিয়ামতের দিন, এমনকি আল্লাহভীরু ও নবী-রাসূলগণও জিজ্ঞাসিত হবেন। দুনিয়া থেকে কেবল বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তাই গ্রহণ করতে হবে; অবশিষ্ট সময় জ্ঞানার্জন, নৈতিকতা চর্চা, ইবাদত ও বন্দেগিতে ব্যয় করা উচিত।

মুনাফিকির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে তিনি বলেন, দুনিয়া মুত্তাকীদের স্থান নয়, বরং মুনাফেকদের আবাস। ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর মুনাফেকদের আঘাত কখনো কখনো কাফেরদের চেয়েও মারাত্মক হয়। আমরা যদি মুমিন ও মুত্তাকি হতে চাই, তবে শরীরের সুস্থতা ও নফসের পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে, কারণ এই স্বল্পস্থায়ী যাত্রায় মানুষের মূলধন হলো পবিত্র নফস।

তিনি বলেন, আল্লাহ আখিরাতে আমাদের কাছ থেকে ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি চান না; ا یَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَی اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِیمٍ “কোনো সম্পদ ও কোনো সন্তান-সন্ততি উপকারে আসবে না, তবে সে-ই ছাড়া যে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে এক ক্বালবে সালিম বা সুস্থ অন্তর নিয়ে।” (সূরা আশ-শু‘আরা, ২৬:৮৮-৮৯) 'ক্বালবে সালিম' বা সুস্থ অন্তর অর্থ সেই হৃদয়, যা পাপের কলুষতা থেকে মুক্ত। মুমিনের উচিত প্রতিদিন আল্লাহর কাছে আরও উচ্চতর তাওফিক কামনা করা এবং যা কিছু আছে তাকেই অপ্রতুল মনে করা।

তিনি যোগ করেন, যদি কোনো মুমিন এমন শহরে বসবাস করে, যেখানে সে প্রকৃত ইমামকে চেনে, তবে তার চেষ্টা করা উচিত সেই শহরের সকল বাসিন্দার চেয়ে অধিকতর পরহেযগার হওয়ার। দুনিয়ায় গতি ও প্রতিযোগিতা হয় ভোগ-বিলাস ও সুবিধার জন্য, কিন্তু আখিরাতে প্রতিযোগিতা হয় তাকওয়া ও বন্দেগিতে। পার্থিব যুদ্ধ হয় মানুষের স্বার্থ ও আরাম-আয়েশের জন্য; কিন্তু নবী-রাসূলগণের মধ্যে কখনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

ধন-সম্পদের প্রতি আসক্তির ব্যাপারে সতর্ক করে তিনি বলেন: কোটি কোটি টাকা, প্রাসাদ ও ব্যাংক হিসাব আখিরাতে কোনো উপকারে আসবে না। যে ব্যক্তি দুনিয়ার ওপর নির্ভর করে, সে সর্বদাই ভয় ও আতঙ্কে থাকে। দুনিয়া হল সাক্ষ্যদানের স্থান; যমিন, যুগ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি বাতাসও পাপাচারী মানুষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং কিয়ামতের কিছু পর্যায়ে আল্লাহ জিহ্বাসমূহকে তালাবদ্ধ করে দেবেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু অনন্ত দয়ার ফলে তিনি আমাদের কাছে ইবাদত চান। আল্লাহর রহমত অসীম; এর একাংশ দুনিয়ায় সকল সৃষ্টির মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে এবং এর বিপুল অংশ কিয়ামতের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। জাহান্নাম মানুষের নিজের কৃতকর্মেরই পরিণতি।

আয়াতুল্লাহ হাশেমী ইলিয়া বলেন, দুনিয়া আল্লাহর সৈন্য। যে কেউ আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত থাকে, দুনিয়া তার সেবায় নিয়োজিত হয়; কিন্তু দুনিয়াপ্রেমী মানুষ যত বেশি পায়, ততই তার লালসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমান বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অগাধ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও আরও লোভ করে।

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দুনিয়াকে গালি দিয়ো না; দুনিয়া মুমিনের জন্য উত্তম বাহন। দুনিয়াকে মন্দ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়নি, বরং তা এক মহান নেয়ামত। সমস্যা মানুষের, যে তা ব্যবহারে ভুল করে। আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-ও বলেছেন, তুমি দুনিয়ার নিন্দা করছ, অথচ তুমি নিজেই তার ফাঁদে পড়েছ।

নৈতিকতার এই শিক্ষক সমাপ্তি টেনে বলেন, দুনিয়া একটি বাজার। একদল এই বাজারে লাভবান হয়, আরেক দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাকওয়াবানরা রাত-দিন আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকে, তাদের যিকির ও ইবাদত রয়েছে এবং তাদের জীবনকালই ইবাদত। কিন্তু অন্য দলটি পাপাচার ও শয়তানের সঙ্গী। আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) বলেছেন, দুনিয়ার মোহ বিবেক-বুদ্ধি নষ্ট করে দেয়। মানুষের উচিত মৃত্যু, কবর ও কিয়ামতের কথা স্মরণ করা এবং জেনে রাখা যে, এই পথের শেষ গন্তব্য হলো আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha