হাওজা নিউজ এজেন্সি: মানুষকে যদি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তবে তার পরিণতিতে প্রকাশ পায় নানাবিধ জগত; আর যদি সেই সব জগতকে এক বিন্দুতে সঙ্কুচিত করা হয়, তবে তারই নাম মানুষ। মানুষের সঠিক গঠন মানেই সকল জগতের সঠিকতা, আর মানুষের অবক্ষয় মানেই সকল জগতের অবক্ষয়। পক্ষান্তরে, বাহ্যিকভাবে বিশ্বকে সংশোধন করা সময়সাপেক্ষ, কঠিন এবং ফলপ্রসূ হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মাদ হাদী ফাল্লাহ “মানুষের সংস্কার—বিশ্ব পরিবর্তনের চাবিকাঠি” শীর্ষক বিষয়ে গভীর আলোচনা করেছেন, যা সম্মানিত পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো:
একদিন এক মা পারিবারিক এক মিলনমেলায় অংশ নিতে ঘর থেকে বের হন। তিনি তার সন্তানকে (যে ছিল অত্যন্ত চঞ্চল ও দূরন্ত)— বাবার তত্ত্বাবধানে রেখে যান।
বাবা তখন পড়াশোনায় মগ্ন ছিলেন, আর শিশুটি বারবার তার কাছে এসে নানা প্রশ্ন করতে থাকল। এই আচরণ শিশুটির কোনো দুষ্টুমির ফল ছিল না; বরং এটি ছিল তার স্বাভাবিক কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ।
বাবা কয়েকবার ধৈর্যসহকারে উত্তর দিলেন, কিন্তু বুঝতে পারলেন যে এই প্রশ্নোত্তর চলতেই থাকবে এবং শিশুটি তার পড়াশোনার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
শিশুটিকে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে বাবার চোখে পড়ল একটি বিশ্ব মানচিত্রের পাজল, যেখানে বিভিন্ন দেশ ও তাদের রাজধানীর নাম লেখা ছিল। তিনি মনে মনে ভাবলেন—এই শিশু তো ইংরেজি জানে না, তাছাড়া এমন একটি জটিল মানচিত্র তার বয়সের জন্য বেশ কঠিন। কাজেই এই পাজলটি দিলে সে কিছু সময় ব্যস্ত থাকবে এবং তিনি নিজের কাজে মন দিতে পারবেন। এই ভেবে তিনি পাজলটি শিশুটির হাতে তুলে দিলেন।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শিশুটি— পাজলটি সম্পূর্ণ সঠিক ও নিখুঁতভাবে সাজানো অবস্থায় ফিরে এলো।
বিস্মিত হয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এটা কীভাবে সমাধান করলে? তুমি কি দেশ-শহরের নাম জানো? কেউ কি তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে?”
শিশুটি উত্তর দিল, “না।”
বাবা আবার প্রশ্ন করলেন, “তাহলে তুমি কীভাবে এত বড় একটি বিশ্বের মানচিত্র ঠিকভাবে সাজাতে পারলে?”
শিশুটি বলল, “বাবা! এই পাজলের উল্টো পিঠে একটি মানুষের ছবি ছিল। আমি আগে মানুষটির ছবিটা ঠিক করেছি; যখন মানুষটি ঠিক হয়ে গেল, তখন দুনিয়াটাও ঠিক হয়ে গেল।”
এই ছোট্ট ঘটনার মধ্যেই এক গভীর সত্য নিহিত রয়েছে।
মানুষকে যদি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তার মধ্যেই প্রতিফলিত হয় এই নানাবিধ জগতসমূহ; আর যদি সেই সব জগতকে এক বিন্দুতে সঙ্কুচিত করা হয়, তবে তার ফলই মানুষ। মানুষের সংশোধন মানেই সকল জগতের সংশোধন; আর মানুষের অবক্ষয় মানেই সকল জগতের অবক্ষয়।
যদি কেউ বাহ্যিকভাবে পৃথিবী ও নিজের পরিবেশকে সংশোধন করতে চায়, তবে তাকে দীর্ঘ সময়, প্রচুর শ্রম ও বিপুল ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়; এবং তবুও সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। কিন্তু বিশ্বসংস্কারের সবচেয়ে নিকটবর্তী, সহজ ও কার্যকর পথ হলো— নিজ মানুষটিকে (অর্থাৎ নিজেকে) সংশোধন করা।
অর্থাৎ মানুষ আগে নিজেকে গুছিয়ে নেবে, নিজের চরিত্র ও আচরণকে পরিশুদ্ধ করবে। মানুষ যদি গড়ে ওঠে, তবে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জগতও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংশোধিত হয়ে যাবে। এই পথটি তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল, অধিক কার্যকর এবং এর ফলাফলও অধিক নিশ্চিত।
অতএব বলা যায়, সমাজ কিংবা বিশ্বের প্রকৃত পরিবর্তন বাইরে থেকে নয়, শুরু হয় ব্যক্তিমানুষের ভেতর থেকে! আত্মসংস্কারই হলো সব সংস্কারের মূল ভিত্তি। মানুষ যখন নিজেকে সৎ ও দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তোলে, তখন তার প্রভাব পরিবার, সমাজ এবং সমগ্র বিশ্বে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রতিফলিত হয়।
আপনার কমেন্ট