শনিবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৬:২১
সহিহ বুখারীর আলোকে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আয়েশা (রা.)-এর সংলাপ: হাদিসের সঠিক উপলব্ধি ও বিভ্রান্তির জবাব

কিছু হাদিসকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। বিশেষত সহিহ বুখারীর একটি বর্ণনাকে কেন্দ্র করে দাবি করা হয়—নবী (সা.) নাকি তাঁর স্ত্রীদের মধ্য থেকে একজনের মৃত্যু কামনা করতেন। এই লেখায় সংশ্লিষ্ট হাদিসের পূর্ণ প্রেক্ষাপট, বর্ণনাকারী সূত্র এবং এর সঠিক অর্থ বিশ্লেষণ করে বিষয়টি স্পষ্ট করা হলো।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, সহিহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদিসে আসে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের একজন—বিশেষত আয়েশা (রা.)—এর প্রসঙ্গে একটি কথা বলেন। হাদিসটির বর্ণনাকারী হলেন কাসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (রহ.), যিনি আয়েশা (রা.)-এর ভাতিজা এবং তাঁর থেকেই এই বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। হাদিসটি সহিহ বুখারীতে বিভিন্ন সনদে এসেছে; হাদিস নম্বরের ক্ষেত্রে বর্ণনায় কিছু পার্থক্য (৫৬/৬৬ ইত্যাদি) দেখা যায়।

কাসিম (রহ.) বর্ণনা করেন, একদিন আয়েশা (রা.) বললেন:
“ওহ আমার মাথা! ওহ আমার মাথা!”
এটি আরবি ভাষার একটি প্রচলিত উপমা, যার দ্বারা বোঝানো হয়—তীব্র ব্যথা, গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুসদৃশ অবস্থা।

এই প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যদি এমন ঘটনা ঘটে এবং তুমি দুনিয়া থেকে চলে যাও আর আমি জীবিত থাকি, তবে আমি তোমার জন্য ইস্তিগফার করব এবং তোমার জন্য দোয়া করব।”

এই কথা শুনে আয়েশা (রা.) আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং বলেন:
“ওহ আমার সর্বনাশ!”

এরপর তিনি আল্লাহর শপথ করে বলেন:
“ওয়াল্লাহি, আমি নিশ্চিত (لَأَظُنُّكَ) যে তুমি আমার মৃত্যু পছন্দ কর।”

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো—‘অযুন্নুকা’ শব্দটি সাধারণ ধারণা বা অনুমানের অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ এর আগে ‘ওয়াল্লাহি’ (আল্লাহর শপথ) ব্যবহৃত হয়েছে এবং বাক্যে ‘লাম’ দ্বারা জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে এটি এখানে দৃঢ় বিশ্বাস বা আবেগতাড়িত নিশ্চিত বক্তব্যের অর্থে এসেছে, নিছক সন্দেহের অর্থে নয়।

এরপর আয়েশা (রা.) বলেন:
“যদি আমি মারা যাই, তবে সেই দিনের শেষভাগেই—অর্থাৎ সেই রাতেই—তুমি তোমার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে যাবে, আনন্দ করবে এবং বিয়ের উৎসব করবে।”

গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ:

এই বর্ণনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়—

১. সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতা:
আহলে সুন্নাহর সর্বসম্মত আকিদা অনুযায়ী সাহাবিগণ—বিশেষ করে আয়েশা (রা.)—নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-সহ বহু আলেম এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।
সুতরাং যদি কেউ বলে যে আয়েশা (রা.) এখানে মিথ্যা বলেছেন—নাউজুবিল্লাহ—তাহলে তা সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ আকিদাগত বিচ্যুতি।

২. নবী (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি:
আবার যদি বলা হয় যে নবী (সা.) সত্যিই আয়েশা (রা.)-এর দ্রুত মৃত্যু কামনা করতেন বা তাঁর মৃত্যুর পরপরই অন্য স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠতে চাইতেন—তাহলে তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহান চরিত্র, দয়া ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

৩. হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা:
এই বর্ণনাটি সহিহ বুখারী থেকে এসেছে—যা কুরআনের পর মুসলিম উম্মাহর কাছে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। এর সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। আহলে সুন্নাহর মতে, সহিহ বুখারীর কোনো হাদিস অস্বীকার করা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়।

উপসংহার:

এই হাদিসকে বিচ্ছিন্নভাবে বা আবেগের ভিত্তিতে নয়, বরং নবী (সা.) ও আয়েশা (রা.)-এর দাম্পত্য জীবনের আন্তরিকতা, মানবিক আবেগ এবং ভাষাগত রীতির আলোকে বুঝতে হবে। এখানে কোনোভাবেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্রে দোষারোপের অবকাশ নেই। বরং এটি তাঁদের পারস্পরিক স্নেহ, আবেগ ও মানবিক কথোপকথনের একটি বাস্তব চিত্র—যা সঠিক প্রেক্ষাপটে বুঝলেই সব বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha