শনিবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৯:৫০
আত্মসংস্কার ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়!

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, আদর্শহীন দলীয় রাজনীতি ও ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে যখন জনমনে প্রশ্ন ও উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে, তখন রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক ভিত্তি নিয়ে নতুন করে ভাবনার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। হাওজা নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কেবল আইন, কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সুস্থ পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়; বরং ব্যক্তি ও নেতৃত্বের নৈতিক ও আত্মিক সংস্কারই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম ও অপরিহার্য শর্ত।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, দলগুলোর আদর্শিক সংকট এবং ধর্মকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরেন, যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: সম্মানিত ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন, আপনি বলছেন—“আত্মসংস্কার ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়।” এই বক্তব্যের মূল দর্শনটি কী?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: বাংলাদেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার—এমন নানা শব্দ ও স্লোগান শুনছি। কিন্তু একটি মৌলিক প্রশ্ন প্রায়ই অনুচ্চারিত থেকে যায়—যে ব্যক্তি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সেই ব্যক্তির নৈতিক ও আত্মিক সংস্কার কি আদৌ ঘটেছে?

রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থা জনগণের চরিত্র, নৈতিকতা ও আচরণের প্রতিফলন। তাই নেতৃত্বের নির্বাচন বা শাসনের ফলাফল জনগণের নৈতিক মান ও আচরণের ওপর নির্ভরশীল। যেমন আমিরুল মু'মিনিন ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,

 كَمَا تَكُونُونَ يُوَلَّىٰ عَلَيْكُمْ

তোমরা যেমন হবে, তোমাদের ওপর তেমন শাসকই নিযুক্ত হবে।

রাষ্ট্র কোনো বিমূর্ত কাঠামো নয়; রাষ্ট্র গঠিত হয় মানুষ দিয়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কেবল কাঠামোগত সংস্কার দিয়ে কোনো রাষ্ট্র টেকসইভাবে এগোতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন—

 إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” (সূরা রা‘দ: ১১)

এই আয়াত রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক নীতিই তুলে ধরে। আইন বদলানো যায়, সংবিধান সংশোধন করা যায়, কিন্তু যদি নেতৃত্ব ও সমাজের ভেতরে নৈতিকতা, সততা ও আত্মসংযম না থাকে, তবে সেই সংস্কার কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই আত্মসংস্কারকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শহীনতার পেছনে আপনি কী কারণ দেখেন?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: অনেক রাজনৈতিক দলই তাদের নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। আদর্শের জায়গা দখল করেছে ক্ষমতা ও স্বার্থ। ফলে দলীয় রাজনীতি আর ন্যায়বিচার ও জনগণের কল্যাণের বাহক থাকছে না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

 مَنْ وَلَّىٰ مِنْ أَمْرِ الْمُسْلِمِينَ شَيْئًا وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّ فِيهِمْ مَنْ هُوَ أَوْلَىٰ بِهِ مِنْهُ فَقَدْ خَانَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ

“যে ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণ করে অথচ জানে তার চেয়ে যোগ্য কেউ আছে, সে আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে।”
এই হাদীস আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতা ও নৈতিকতার প্রশ্নটি স্পষ্ট করে দেয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাজনীতিতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ধর্ম কখনোই অন্যায় বা জুলুমের হাতিয়ার হতে পারে না। অথচ আমরা দেখছি, কেউ কেউ ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালার ময়দানে বলেছিলেন,

 إِنِّي لَمْ أَخْرُجْ أَشِرًا وَلَا بَطِرًا وَلَا مُفْسِدًا وَلَا ظَالِمًا، إِنَّمَا خَرَجْتُ لِطَلَبِ الْإِصْلَاحِ فِي أُمَّةِ جَدِّي

“আমি ক্ষমতার জন্য বিদ্রোহ করিনি; আমি বিদ্রোহ করেছি আমার নানার উম্মাহকে সংস্কার করার জন্য।”

এই বাণী প্রমাণ করে, প্রকৃত ধর্মীয় আন্দোলনের লক্ষ্য ক্ষমতা নয়, বরং ন্যায় ও সংস্কার।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে আত্মসংস্কারের গুরুত্ব কতটা?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: ইসলামে আত্মসংস্কার রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্বশর্ত। আত্মসংস্কার মানে শুধু ইবাদত নয়; বরং সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা।

হযরত আলী (আ.) বলেছেন—

مَنْ أَصْلَحَ سَرِيرَتَهُ أَصْلَحَ اللَّهُ عَلَانِيَتَهُ

“যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে সংশোধন করে, আল্লাহ তার বাহ্যিক অবস্থাও সংশোধন করে দেন।” অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ যদি নিজেদের ইসলামের রঙে রঙ্গিন হোন, রাজনৈতিক পরিবেশ ও রাষ্ট্রও ইসলামের রঙে সাজবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের ক্ষেত্রে আত্মসংস্কারের বাস্তব রূপ কী হতে পারে?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: যদি রাজনীতিবিদ নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করেন, প্রশাসক যদি ক্ষমতাকে আমানত না ভেবে সুযোগ মনে করেন এবং নাগরিক যদি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে নেন—তবে রাষ্ট্র সংস্কার কেবল কল্পনাই থেকে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

 كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকের কাছেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” এই হাদীস ক্ষমতার জবাবদিহির নৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কী বার্তা?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: তরুণদের বলব—নৈতিকতা ও বিবেককে পথপ্রদর্শক বানাও। হযরত আলী (আ.) বলেছেন—

 لَا قِيمَةَ لِامْرِئٍ لَا خُلُقَ لَهُ

“যার নৈতিকতা নেই, তার কোনো মূল্য নেই।”

নৈতিক ও আত্মসংস্কারিত তরুণরাই পারে জাতিকে নতুন পথে নিতে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: সবশেষে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: আমি আশাবাদী, তবে শর্তসাপেক্ষে। রাষ্ট্র সংস্কার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যার সূচনা হতে হবে আত্মসংস্কার দিয়ে। নৈতিকতা ও আত্মিক দায়বদ্ধতা ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হবে।

আজ সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো—আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নিজেদের কতটা সংস্কার করতে প্রস্তুত? কারণ কুরআন, ইতিহাস ও আহলে বাইতের শিক্ষা একই সত্য ঘোষণা করে: আত্মসংস্কার ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রাসেল আহমেদ রিজভী 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha