বৃহস্পতিবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৩:২৪
সৎকাজের আদেশ পরিত্যাগ করলে ক্ষমতায় আসে নিকৃষ্টরা

নাহজুল বালাগার আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র রক্ষার মৌলিক দায়িত্ব তুলে ধরলেন বিশেষজ্ঞ

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, নাহজুল বালাগায় আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) এমন এক ইতিহাসগঠনকারী সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন, যা আজও সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্য বহন করে। তিনি বলেন,
“যদি তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ পরিত্যাগ করো, তবে তোমাদের উপর তোমাদেরই নিকৃষ্ট লোকেরা শাসন করবে, আর তখন তোমাদের দোয়া কবুল হবে না।”

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ (আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার) কেবল ব্যক্তিগত নসিহত নয়; বরং এটি একটি কার্যকর সমষ্টিগত প্রতিরোধব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে সমাজ নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সুরক্ষিত থাকে। আর এই দায়িত্ব উপেক্ষিত হলে দুর্নীতি ও অন্যায়ের ঢেউ ভালো-মন্দ সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই প্রতিরোধব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে ওলায়াত ও দ্বীনি নেতৃত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই ফরজ পালনে অবহেলা এবং ঐশী নেতৃত্বের প্রতি উদাসীনতার পরিণতি কী?

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতে হাওজা নিউজ এজেন্সি কথা বলেছে নাহজুল বালাগার বিশিষ্ট গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম আলী আকবর ইয়াজদিয়ান–এর সঙ্গে।

এই ফরজের মাধ্যমেই অন্য সব ফরজ প্রতিষ্ঠিত হয়

হুজ্জাতুল ইসলাম ইয়াজদিয়ান বলেন, নাহজুল বালাগা ও বিভিন্ন হাদিসে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি আমিরুল মুমিনীন (আ.)–এর বাণী উদ্ধৃত করে বলেন—

 “بِها تُقامُ الفَرائضُ”
অর্থাৎ, এর মাধ্যমেই অন্যান্য ফরজসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই ফরজকে যথার্থভাবেই “সব ফরজের বসন্তকাল” বলা যায়। কারণ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কার্যকর না থাকলে অন্যান্য ধর্মীয় বিধানও ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

ব্যক্তিগত নয়, সর্বজনীন দায়িত্ব

ইয়াজদিয়ান আরও বলেন, এই দায়িত্বকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয়। এটি শুধু ব্যক্তিগত আচরণ বা নির্দিষ্ট সামাজিক ইস্যুতে উপদেশ দেওয়ার মধ্যে আবদ্ধ নয়; বরং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ রয়েছে। সমাজের সব স্তরে এই ফরজ পালন করা হলে অন্যান্য ঐশী বিধানও দৃঢ়ভাবে টিকে থাকে।

ঈমানের স্তম্ভ হিসেবে আমর বিল মারুফ

নাহজুল বালাগার ৩১ নম্বর হিকমাতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আমিরুল মুমিনীন (আ.) ঈমানের চারটি মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেছেন—ধৈর্য, দৃঢ় বিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতা ও সংগ্রাম।

সংগ্রাম (মুজাহাদা) সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেন, প্রকৃত মুজাহিদ সেই ব্যক্তি—

যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করে,

পাপাচারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়,

এবং সব পরিস্থিতিতে সত্যের ওপর অবিচল থাকে।

এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ঈমানের এক মৌলিক স্তম্ভ।

চার শ্রেণির মানুষ: নাহজুল বালাগার সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ

নাহজুল বালাগার ৩৭৪ নম্বর হিকমাতে সমাজের মানুষকে সৎ ও অসৎ কাজের প্রতি তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন আমিরুল মুমিনীন (আ.)—

১. সর্বোত্তম শ্রেণি:
যারা অন্তরে ভালো-মন্দ চেনে, মুখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এবং কাজে-কর্মে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

২. দ্বিতীয় শ্রেণি:
যারা ভালো-মন্দ চেনে ও মুখে প্রতিবাদ করে, কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।

৩. তৃতীয় শ্রেণি:
যারা কেবল অন্তরে ভালো-মন্দ চেনে, কিন্তু না কথা বলে, না কাজে এগিয়ে আসে।

৪. চতুর্থ শ্রেণি:
যারা না অন্তরে চেনে, না মুখে প্রতিবাদ করে, না কাজে কোনো ভূমিকা রাখে। এদের সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেন,
এরা মৃতদের মাঝে জীবিত; জীবিতদের মাঝে চলমান মৃত।

এই শ্রেণির মানুষ সমাজের জন্য সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও মূল্যহীন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সত্য বলা থেকেই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়

হিকমতের শেষাংশে আমিরুল মুমিনীন (আ.) জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যে অত্যাচারী ও স্বৈরশাসকের সামনেও সত্য বলতে পিছপা হয় না। সুতরাং ন্যায়পরায়ণ ইসলামী শাসনব্যবস্থা বা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি ভুল করলে, তার সামনে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha