হাওজা নিউজ এজেন্সি: হাওজায়ে ইলমিয়ার শিক্ষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ হুসাইন মো’মেনী শুক্রবার রাতে তেহরানের পবিত্র দরগাহ হযরত আব্দুল আজিম হাসানী (আ.)-এর প্রাঙ্গণে অবস্থিত ইমাম খোমেনি (রহ.) শবিস্তানে এক ধর্মীয় বক্তৃতায় দোয়ার অবস্থান, দোয়া কবুল হওয়ার দর্শন এবং পবিত্র রজব মাসে বিদ্যমান বিশেষ আধ্যাত্মিক সুযোগসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি বক্তব্যের শুরুতে বান্দা ও প্রভুর সম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত সুন্নাহর কথা উল্লেখ করে বলেন, “পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁর বান্দাদের জন্য এমন একটি পথ নির্ধারণ করেছেন, যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিপালকের সঙ্গে কথা বলতে পারে এবং নিজেদের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা তাঁর দরবারে পেশ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের প্রয়োজন তুলে ধরবে, তার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে।”
নির্বাচিত মাসসমূহে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মো’মেনী বলেন, “ইসলামের ইবাদতভিত্তিক বর্ষপঞ্জিতে কিছু মাসের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। পবিত্র রজব, শা‘বান ও রমজান—এই তিনটি মাস আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত মাস। অর্থাৎ এসব সময়ে আল্লাহর রহমত সাধারণ সময়ের তুলনায় বিশেষভাবে বান্দাদের ওপর অবতীর্ণ হয় এবং ইবাদতকারী ও দোয়াকারীদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “এই কারণেই ইসলামী বর্ণনাসমূহে এই তিন মাসে আত্মসংযম, আত্মসমালোচনা, তওবা ও আল্লাহর প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।”
নির্বাচিত দিন ও গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ
তিনি বলেন, “মাসের পাশাপাশি কিছু দিনও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে নির্বাচিত। যেমন—শুক্রবার, যা সারা বছরে দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে পরিচিত। তেমনি আরাফার দিন, গাদীরের দিন এবং আরও কিছু বিশেষ ধর্মীয় উপলক্ষ এমন সময়, যখন মানুষকে আল্লাহর দরবারে বিনীতভাবে দোয়ার পসরা সাজাতে উৎসাহিত করা হয়েছে।”
দোয়া কবুলের বিশেষ সময়সমূহ
এই হাওজায়ে ইলমিয়ার শিক্ষক বলেন, “ইসলামী বর্ণনায় দোয়া কবুলের কিছু নির্দিষ্ট সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন—সেহরির সময়, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, শুক্রবারের জাওয়ালের পূর্ব মুহূর্ত, শুক্রবার সূর্যাস্তের আগের সময় এবং বৃষ্টিবর্ষণের সময়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এমনকি যখন কোনো ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিবাহবন্ধন সম্পন্ন হয়—সে মুহূর্তটিও দোয়া কবুলের অত্যন্ত নিকটবর্তী সময়। অথচ দুঃখজনকভাবে অনেক মানুষ এই মহামূল্যবান সুযোগ সম্পর্কে সচেতন নন।”
দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানসমূহ
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মো’মেনী বলেন, “কিছু স্থান এমন রয়েছে, যেখানে আল্লাহর রহমত বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়। যেমন—নিজ ঘরে নির্ধারিত ইবাদতের স্থান, মসজিদ, তাকিয়া, ইমামজাদা দরগাহ, শহীদদের কবর, মুসলমানদের কবরস্থান এবং এমনকি পিতা-মাতার কবর—বিশেষ করে মায়ের কবর।”
মৃত্যুর পরও মায়ের দোয়ার কার্যকারিতা
তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি বর্ণনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “ইসলামী বর্ণনায় এসেছে—মা ইন্তেকাল করার পরও তাঁর কবরের পাশে করা সন্তানের দোয়া কবুলের খুব কাছাকাছি থাকে। এটি প্রমাণ করে যে সন্তান ও পিতামাতার আত্মিক ও হৃদ্যিক সম্পর্ক মৃত্যুর পরও বিচ্ছিন্ন হয় না।”
আহলে বাইতের (আ.) দরবার—দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র
তিনি বলেন, “আহলে বাইতের (আ.) পবিত্র মাজারসমূহ দোয়া কবুলের বিশেষ ও নিশ্চিত স্থান।রাসূলুল্লাহ (সা.) ইমাম রেজা (আ.)-এর জিয়ারত সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে তাঁর জিয়ারতকারী নিজ প্রয়োজন পূরণে সফল হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এসবের মধ্যেও সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হলো কারবালার পবিত্র ভূমি—যেখানে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর গম্বুজের নিচে করা দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়।”
দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুত রাতসমূহ
তিনি বলেন, “শুক্রবার রাত, আইয়ামে বীয (চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ), রজব মাসের মধ্যরাত, মহানবী (সা.)-এর মাব‘আসের রাত, কদরের রাতসমূহ এবং বিশেষ করে লাইলাতুর রাগায়েব—এসব রাত দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুত সময় হিসেবে পরিচিত।”
দোয়ার প্রকৃত অর্থ ও বাস্তবতা
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মোমেনী বলেন, “দোয়া কেবল মুখে কিছু চাওয়ার নাম নয়। আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) দোয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘দোয়া হলো বান্দার এমন এক অবস্থা তৈরি করা, যাতে আল্লাহ তার প্রতি মনোযোগ দেন।’ অর্থাৎ বান্দাকে আগে নিজেকে আল্লাহর নৈকট্যের উপযোগী করে তুলতে হবে, তারপর নিজের প্রয়োজন পেশ করতে হবে।”
দোয়া কবুলে বিলম্ব—আল্লাহর অনুগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ
বক্তব্যের শেষভাগে তিনি বলেন, “ইসলামী বর্ণনায় এসেছে—যদি আল্লাহ তায়ালা কারো দোয়া কবুল করতে না চাইতেন, তবে তাঁকে দোয়া করার তাওফিকই দিতেন না। অনেক সময় দোয়া কবুলে বিলম্ব ঘটে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ থেকেই, কারণ তিনি চান বান্দা আরও বেশি সময় তাঁর দরবারে অবস্থান করুক এবং এই সময়ের মধ্যেই তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হোক।”
আপনার কমেন্ট