মঙ্গলবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৬:০১
শাইখ জাকজাকি: নতুন রূপে আফ্রিকা বিভাজনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে

আমাদের বক্তব্য সেই শাসকদের প্রতি, যারা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নিজেদের জনগণকে হত্যা করে। জেনে রাখুন, যখন আপনাদের কাজ শেষ হবে, তখন যারা আপনাদের ব্যবহার করেছে, তারাই আপনাদেরও হত্যা করবে—যেমনটি তারা সাদ্দাম ও গাদ্দাফির সাথে করেছিল।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, নাইজেরিয়ার চলমান ঘটনাপ্রবাহ এবং বিশেষ করে আফ্রিকার বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপটে আফ্রিকান গণমাধ্যমগুলো ২৫ রজব ১৪৩৫ হিজরি (২৪/৫/২০১৪ খ্রি.) তারিখে নাইজেরিয়ার জারিয়া শহরে “ইয়াওমুশ শুহাদা” অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক মুসলিম ভাই ও বোনের উপস্থিতিতে প্রদত্ত শাইখ ইব্রাহিম জাকজাকির ঐতিহাসিক ভাষণটি পুনঃপ্রকাশ করেছে।
এই ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণ পাঠ নিম্নরূপ:
“বর্তমানে আমরা আমাদের দেশে একটি নতুন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। আমি আগেও বহুবার আমার বক্তৃতায় সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে একটি বড় বিষয় সামনে আসছে। এখন যা ঘটছে, তা নতুন কিছু নয়—এটি হচ্ছে আফ্রিকার পুনরায় দখল।
বিশ্বশক্তিগুলো বহু বছর আগেই ঘোষণা করেছিল যে আগামী শতাব্দী হবে ‘আফ্রিকার শতাব্দী’। কেন? কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আফ্রিকায় রয়েছে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবারও আফ্রিকাকে দখল করার—নতুন কৌশলে। যাকে তারা নিজেরাই বলছে ‘আফ্রিকা বিভাজনের দ্বিতীয় অভিযান’।
আফ্রিকা বিভাজনের প্রথম পর্যায়ে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো—ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল ও বেলজিয়াম—বার্লিন সম্মেলনে একত্রিত হয়ে আফ্রিকা মহাদেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। আজ সেই একই দৃশ্যপট, তবে নতুন মুখোশে, আবারও বাস্তবায়িত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা আফ্রিকা পুনর্দখলের জন্য ‘সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করবে। আজ আমরা যা দেখছি, তা ঠিক সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
তারা এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে লিবিয়া থেকে। আরব জনগণের জাগরণ ও মিশরের গণঅভ্যুত্থান পশ্চিমা শক্তিকে আতঙ্কিত করে তোলে। এরপর তারা লিবিয়া ধ্বংস করে, গাদ্দাফিকে হত্যা করে এবং এমন একটি দেশ রেখে যায় যেখানে কেবল হত্যা, গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাত চলছে—আর তারা নির্বিঘ্নে সম্পদ লুট করছে।
লিবিয়া ও নাইজেরিয়া—উভয় দেশেই উৎকৃষ্ট মানের তেল রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘সুইট ক্রুড অয়েল’। লিবিয়ার তেল এখন কার্যত তাদের দখলে, আর নাইজেরিয়ার তেল বহু বছর ধরেই লুণ্ঠিত হচ্ছে। তারা শুধু কিছু মূল্যহীন মোহরা—একজন পুতুল রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, গভর্নর বা মন্ত্রী—নিয়োগ করে, যাতে তারা দেশের সম্পদ লুট করতে পারে।
এখন তারা নতুন পদ্ধতিতে দেশ দখল করছে। এ কারণেই তারা মালি দখল করেছে। কিদাল ও গাও শহরের সংঘর্ষের খবর আমরা শুনছি। হঠাৎ কিছু সশস্ত্র লোক হাজির হয়, এলোপাতাড়ি গুলি চালায়, তারপর বলা হয়—এরা নাকি ‘ইসলামি জিহাদি’।
অথচ বাস্তবতা হলো—মালিতে বিপুল স্বর্ণসম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই স্বর্ণ, যার গল্প বহু যুগ ধরে শোনা যায়; ঐতিহাসিক মালি সম্রাট মানসা মুসার যুগের সঙ্গে যার সম্পর্ক রয়েছে।
এই সম্পদ আবিষ্কারের পরই মালিকে দখলের পরিকল্পনা করা হয়। বলা হয়, আলজেরিয়া থেকে কিছু গোষ্ঠী এসে মালির অর্ধেকের বেশি এলাকা দখল করেছে এবং ‘আজাওয়াদ’ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করেছে। এরপর ফ্রান্স প্রবেশ করে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাটক করে, অথচ প্রকৃত লক্ষ্য ছিল স্বর্ণ লুট।
মধ্য আফ্রিকায়ও তথাকথিত ‘সেলেকা’ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর অজুহাতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়—যাদের প্রকৃত পরিচয় আজও অজানা। পরে ‘অ্যান্টি-বালাকা’ নামে খ্রিস্টান মিলিশিয়াদের সংগঠিত করা হয় মুসলমানদের, বিশেষ করে ফুলানি রাখালদের গণহত্যার জন্য। এখানেও আসল লক্ষ্য ছিল হীরা।
মধ্য আফ্রিকায় বলা হলো, ‘মাইকেল ওডোফিয়া’ নামে একজন ‘মুসলিম নেতা’ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে! কখনো কি আপনারা ‘মাইকেল’ নামের কোনো মুসলমান শুনেছেন? এসব নির্লজ্জ মিথ্যা শুধু সামরিক হস্তক্ষেপ ও মুসলমান হত্যার অজুহাত।
একই ছক দক্ষিণ সুদানে গোত্রীয় বিভেদ উসকে দিয়ে এবং নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে—যা বহু মার্কিন বিশ্লেষকও স্বীকার করেছেন যে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৈরি।
স্কুলছাত্রী অপহরণের ঘটনাটিও ছিল একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প। পরিবারগুলো ভালো করেই জানে, কারা তাদের সন্তানদের অপহরণ করেছে। জনাথন সরকার এর সরাসরি দায়ী। প্রতিবাদ অর্থহীন—যদি সরকার দায়ী হয়, সরকারকেই জবাবদিহি করুন; আর যদি বোকো হারাম হয়, তবে সে কোথায়? সেও তো সরকারি সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।

বোকো হারামের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই; এটি একটি বিশাল মিথ্যা। যদি আপনাদের উদ্দেশ্য বাণিজ্য হয়, আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য করুন। কিন্তু আমাদের ধর্মকে প্রতারণার হাতিয়ার বানাবেন না এবং ভান করবেন না যে আমাদের উদ্ধার করতে এসেছেন—আপনারা এসেছেন লুট করতে।
এখন আসল সন্ত্রাসবাদ অর্থাৎ আমেরিকা ময়দানে নেমেছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে যে মডেল প্রয়োগ করা হয়েছিল, এখানেও তাই চলছে। বিন লাদেন ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাতে দেশ ধ্বংস করে, তারপরও তাদের সম্পদ চুরি করে যাচ্ছে।
নাইজেরিয়াতেও একই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে—জামফারা, বিরনিন গোয়ারি, জারিয়া, সোকোতো ও বোর্নো অঞ্চলের স্বর্ণ, ইউরেনিয়াম ও মূল্যবান ধাতুর জন্য।
আমাদের বক্তব্য সেই শাসকদের প্রতি, যারা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নিজেদের জনগণকে হত্যা করে। জেনে রাখুন—যখন আপনাদের কাজ শেষ হবে, তখন যারা আপনাদের ব্যবহার করেছে, তারাই আপনাদের হত্যা করবে; যেমনটি তারা সাদ্দাম ও গাদ্দাফির সঙ্গে করেছে।
এই সংকট সরাসরি আমাদের লক্ষ্য করে এসেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। এই পথে যে নিহত হবে, সে শহীদ। আমাদের অস্ত্র রয়েছে—ঈমান, সচেতনতা ও প্রতিরোধ।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের আগামী ইয়াওমুশ শুহাদা পর্যন্ত নিরাপদ রাখেন, আমাদের সাহায্য করেন এবং শত্রুদের ওপর বিজয় দান করেন।
وَصَلَّی اللَّهُ عَلَیٰ مُحَمَّدٍ وَآلِهِ الطَّاهِرِینَ
وَالسَّلَامُ عَلَیْکُمْ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَکَاتُهُ”
সূত্র: শাইখ ইব্রাহিম জাকজাকির রচনাবলি প্রকাশনা কেন্দ্র (হাফিযাহুল্লাহ)।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha