হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০ই রজব বিশ্বব্যাপী শিয়া মুসলমানদের নবম ইমাম হযরত ইমাম মুহাম্মদ তাকী (আ.), জাওয়াদুল আইম্মা (আ.)—অষ্টম হুজ্জাত হযরত ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেজা (আ.)-এর প্রিয় সন্তান ও হৃদয়ের প্রশান্তি—এর শুভ জন্মবার্ষিকীর স্মরণীয় দিন। এই আনন্দঘন উপলক্ষে আপনাদের সকলের প্রতি, বিশেষত হযরত ইমাম যামানা (আ.)-এর পবিত্র দরবারে, অন্তরের গভীরতা থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সংক্ষিপ্ত জীবন, মহান অবদান ও উজ্জ্বল নৈতিক মর্যাদা
নবম ইমাম, যাঁর পবিত্র নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু জাফর এবং সর্বাধিক প্রসিদ্ধ উপাধি ‘তাকী’ ও ‘জাওয়াদ’, ১০ই রজবুল মুরাজ্জব এবং এক বর্ণনা অনুযায়ী ১৯শে রমজানুল মুবারক, হিজরি ১৯৫ সালে মদীনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর সম্মানিত পিতা ছিলেন হযরত ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেজা (আ.), আর তাঁর মাতা ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার নারী সাবিকা, যাঁকে ইমাম রেজা (আ.) ‘খায়যরান’ নামে স্মরণ করতেন। নৈতিক গুণাবলিতে তিনি তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর স্ত্রীকে পবিত্রতা, শালীনতা ও উচ্চ নৈতিক চরিত্রে অতুলনীয় বলে উল্লেখ করতেন।
ইমাম জাওয়াদ (আ.) কম পরিচিত হওয়ার কারণ
ইতিহাসগতভাবে ইমাম জাওয়াদ (আ.) তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত হওয়ার দুটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হয়।
প্রথমত, তাঁর শৈশবকালীন ইমামত ও সংক্ষিপ্ত জীবন—তিনি মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পঁচিশ বছর বয়সে শহীদ হন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর যুগের বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট; আব্বাসীয় খিলাফত তখন অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছিল, বিশেষ করে মামুন ও মু‘তাসিমের শাসনামলে। এই জটিল পরিস্থিতি ইমামের সামাজিক ও দাওয়াতমূলক কর্মকাণ্ড সীমিত করে দেয়।
নৈতিক ও জ্ঞানগত গুণাবলি
ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন নববী চরিত্রের পূর্ণ প্রতিফলন। উত্তম চরিত্র, সহনশীলতা, ধৈর্য, বিনয় এবং ক্ষমাশীলতা ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্রকে সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, আর আহলে বাইত (আ.)-এর ইমামগণ সেই নৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী ছিলেন।
জ্ঞানক্ষেত্রেও ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর অবস্থান ছিল ব্যতিক্রমী। অল্প বয়স সত্ত্বেও তিনি ইলমে লাদুন্নীর অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর যুগের প্রখ্যাত আলেমদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিতর্কে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। শিয়া বিশ্বাস অনুযায়ী এই জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে আমিরুল মুমিনীন (আ.) এবং পরবর্তীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইমামদের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে।
তাকওয়া, ইবাদত ও স্বাধীনচেতা মনোভাব
ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন তাকওয়া ও পরহেজগারির জীবন্ত দৃষ্টান্ত। ইবাদত, আল্লাহর স্মরণ এবং দীর্ঘ সিজদা তাঁর পবিত্র জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক; জুলুম ও অত্যাচারের সামনে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। এই গুণটি আহলে বাইতের সকল ইমামের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়।
ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কারামত
ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর জন্ম নিজেই ছিল এক মহান ঐশী কারামত। ইমাম রেজা (আ.) বহুবার তাঁকে ইসলামের সর্বাধিক বরকতময় সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। অল্প বয়সে ইমামতের দায়িত্ব লাভ এবং জ্ঞানগত বিতর্কে অসাধারণ সাফল্য তাঁর ইমামতের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ—যেমন পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)-এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
শিষ্যবৃন্দ ও জ্ঞানগত প্রভাব
সংক্ষিপ্ত জীবনকাল সত্ত্বেও ইমাম জাওয়াদ (আ.) বহু উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শিষ্য গড়ে তুলেছিলেন, যাঁরা ইসলামী জ্ঞান ও মারেফাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হযরত আবদুল আজীম হাসানী (রহ.), আলী ইবনে মাহযিয়ার আহওয়াজী (রহ.), ফজল ইবনে শাজান নিশাপুরী (রহ.) ও দা‘বাল খুযাঈ (রহ.) তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের অন্তর্ভুক্ত।
এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম জাওয়াদ (আ.) থেকে শুধু শিয়া মুহাদ্দিসরাই নয়, বরং আহলে সুন্নাতের বহু আলেমও হাদিস বর্ণনা করেছেন—যাদের মধ্যে খতিব বাগদাদীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসদের নাম উল্লেখযোগ্য।
শাহাদাত ও পবিত্র মাজার
আব্বাসীয় খলিফা মামুন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁর কন্যা উম্মুল ফজলকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন, কিন্তু এই কৌশলে সে তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। মামুনের মৃত্যুর পর মু‘তাসিম আব্বাসীর নির্দেশে ইমামকে বাগদাদে ডেকে আনা হয়, যেখানে হিজরি ২২০ সালে তাঁকে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়।
আজ তাঁর পবিত্র মাজার বাগদাদের কাযেমাইনে তাঁর সম্মানিত দাদা হযরত ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর পাশেই অবস্থিত, যা বিশ্বব্যাপী মুমিনদের জন্য ভক্তি ও প্রার্থনার কেন্দ্র।
“সালাম বর্ষিত হোক তাঁর ওপর—যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, যেদিন তিনি শহীদ হয়েছেন এবং যেদিন তিনি পুনরুত্থিত হবেন।”
তথ্যসূত্র
১. শায়খ মুফীদ, আল-ইরশাদ
২. শায়খ তূসী, তারিখুল আইম্মা
৩. আগা বুজুর্গ তেহরানী, আয্-যরীআ ইলা তাসানিফ আশ-শিয়া
৪. পবিত্র কুরআন, সূরা আল-আহযাব: ২১
৫. শায়খ কুলায়নী, আল-কাফি
৬. আল্লামা বারকী, আল-মুহাসিন
৭. শায়খ সদূক, উইউন আখবার আর-রেজা
৮. ফজল ইবনে শাজান, বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ
৯. খতীব বাগদাদী, তারিখে বাগদাদ
১০. ইবনে শহর আশুব, মানাকিব আলে আবি তালিব
আপনার কমেন্ট