হাওজা নিউজ এজেন্সি: ভালো ঘুম মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনিদ্রা মানুষের জীবনমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই লেখায় আরামদায়ক ও মানসম্মত ঘুম অর্জনের উপায় তুলে ধরা হয়েছে:
ঘুম সৃষ্টিকর্তার এক মহান নিয়ামত, যা মানুষের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় জুড়ে থাকে। শুধু মানুষই নয়, প্রাণীরাও দৈনন্দিন কাজকর্ম ও শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে ঘুমের প্রয়োজন অনুভব করে। সময়মতো ও পরিমিত ঘুম সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর রহস্য এবং স্নায়ু ও মনের প্রশান্তির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
আল্লাহ তাআলা বলেন— “وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا” “আমি তোমাদের ঘুমকে করেছি বিশ্রামের মাধ্যম।” (সূরা নাবা: ৯)
এখন প্রশ্ন হলো—স্বাস্থ্যের অবনতি কি অনিদ্রার কারণ, নাকি অনিদ্রাই স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়?
বাস্তবে এখানে একটি পারস্পরিক ও চক্রাকার প্রভাব বিদ্যমান। শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা প্রথমে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং আবার অনিদ্রা ধীরে ধীরে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়। কোনটি আগে শুরু হয়েছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই মহান নিয়ামত থেকে কীভাবে যথাযথভাবে উপকৃত হওয়া যায় এবং কীভাবে অনিদ্রা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
অনিদ্রার প্রভাবসমূহ
ক. শারীরিক প্রভাব
১. বিষাক্ত পদার্থ, জীবাণু ও রোগের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
২. শারীরিক শক্তি কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং হজম ও পরিপাকে সমস্যা
৩. ইন্দ্রিয়ের কার্যকারিতা ও হরমোনজনিত ব্যবস্থায় বিঘ্ন
খ. মানসিক ও আবেগগত প্রভাব
১. উদ্বেগ, খিটখিটে স্বভাব, দুঃখবোধ, বিষণ্নতা ও পারিবারিক কলহ
২. নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনের প্রতি অসন্তুষ্টি
৩. আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান হ্রাস, সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হওয়া এবং ব্যক্তিগত অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি
গ. বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক প্রভাব
চিন্তাশক্তির ব্যাঘাত, মনোযোগের অভাব, স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা হ্রাস
শিশুদের ঘুমের ব্যাধি
অনেক সময় শিশুর ঘুমের সমস্যা জন্মের পর থেকেই শুরু হয়। বিশেষ করে বারবার জেগে ওঠা বা খাওয়ানোর প্রয়োজনের কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো শিশুর কোনো স্থায়ী শারীরিক সমস্যা না থাকলেও সাময়িক পরিস্থিতিগত কারণে—যেমন মা-বাবার থেকে বিচ্ছেদ, ঘুমের পরিবেশ পরিবর্তন, মানসিক অস্থিরতা অথবা অসুস্থতার ফলে—ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এ কারণে শিশুদের ঘুমের সমস্যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা জরুরি। সমস্যাটি কবে শুরু হয়েছে, কতদিন ধরে চলছে এবং এর তীব্রতা কতটা—এসব বিষয় নির্ণয় করে প্রয়োজনে চিকিৎসক বা পরামর্শকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
আরামদায়ক ও মানসম্মত ঘুমের উপায়
১. বিছানা টিভি দেখা, পড়াশোনা বা কাজের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়; এটি কেবল ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন
২. ৩০ মিনিট চেষ্টা করার পরও ঘুম না এলে বিছানা ছেড়ে উঠে শান্ত কোনো কাজে মন দিন
৩. ঘুমের আগে শিথিলকরণ ব্যায়াম, হালকা ম্যাসাজ বা কুসুম গরম/ঠান্ডা পানিতে গোসল উপকারী
৪. প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো ও জাগার অভ্যাস গড়ে তুলুন, এমনকি ছুটির দিনেও
৫. দিনের বেলা বা সন্ধ্যায় ঝিমুনি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন
৬. সপ্তাহে ৩–৪ দিন নিয়মিত ব্যায়াম করুন, তবে ঘুমের ঠিক আগে নয়
৭. বিকেল ৪টার পর ক্যাফেইনজাতীয় পানীয়, চা, কফি ও ধূমপান পরিহার করুন
৮. খালি পেটে বা অতিরিক্ত ভারী খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাতে যাবেন না
৯. শান্ত, পরিচ্ছন্ন, বাতাস চলাচলকারী এবং কম আলোযুক্ত ঘরে ঘুমানো উচিত
ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি
ক. ইসলামী নির্দেশনা
১. ঘুমের আগে টয়লেটে যাওয়া
২. শরীর পরিষ্কার রাখা, বিশেষ করে হাত ও মুখ ধোয়া
৩. অজু করে ঘুমানো (অজু সম্ভব না হলে তায়াম্মুম করা)
৪. ঘুমের আগে কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া পাঠ—যেমন সূরা তাওহীদ, তাকাসুর, ওয়াকিয়া ইত্যাদি
৫. ডান কাতে বা চিত হয়ে কিবলার দিকে মুখ করে ঘুমানো এবং উপুড় হয়ে না ঘুমানো
খ. মানসিক ও শারীরিক দিকনির্দেশনা
• ঘুমের আগে ভারী শারীরিক পরিশ্রম পরিহার করা
• উত্তেজনাপূর্ণ চলচ্চিত্র, দুঃখজনক স্মৃতি ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ এড়িয়ে চলা
• ধর্মীয় ও শান্ত বই পাঠ করা
• পরদিনের কাজ নিয়ে বিছানায় শুয়ে চিন্তা না করে আগেই পরিকল্পনা করা
• আরামদায়ক ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা
• ঘরের আলো, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সহনীয় রাখা
খাদ্যাভ্যাস ও ঘুম
খাদ্যাভ্যাস ঘুমের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে অনিদ্রার মূল কারণ হজমজনিত সমস্যা।
১. লাল মাংস ও চিনি কম খাওয়া
২. শাকসবজি ও ফলমূল বেশি গ্রহণ করা
৩. দুধ, দই ও পনির সহজপাচ্য হওয়ায় উপকারী
৪. ধীরে ধীরে, ভালোভাবে চিবিয়ে এবং মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে খাবার গ্রহণ করা
আমাদের কতটুকু ঘুম প্রয়োজন?
ঘুমের প্রয়োজন ব্যক্তি ও বয়সভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
শিশুদের সাধারণত দিনে ১৫–১৬ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের প্রয়োজন কমতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের (প্রায় ২০ বছর বয়সে) গড়ে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ঘুমের প্রয়োজন আরও কিছুটা কমে যায়।
গবেষকদের মতে, যারা দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান তারা “স্বল্পঘুমী” এবং যারা ৯ ঘণ্টা বা তার বেশি ঘুমান তারা “দীর্ঘঘুমী”। মানসিক চাপ, অসুস্থতা বা অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রমের সময় ঘুমের প্রয়োজন বৃদ্ধি পেতে পারে।
যদি দিনের বেলায় কর্মক্ষমতা ও সতর্কতা স্বাভাবিক থাকে, তবে ধরে নেওয়া যায় ঘুমের পরিমাণ ও মান যথেষ্ট।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে রাতের প্রথম ভাগে ঘুমানো এবং ভোরে জাগ্রত হওয়াকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে।
সহায়ক সূত্রসমূহ
১. পিটার হ্যারি, Sleep and Insomnia, অনুবাদ: মেহদি কারাচে দাগি, তেহরান, ১৯৭৬
২. জেমস বি. মাস, The Power of Sleep, অনুবাদ: জাহাঙ্গীর বাহারমত, ১৯৭৯
৩. আহমদ লুকমানি, Questions and Answers about Sleep and Dreams, কুম, ২০০০
৪. পবিত্র কুরআন, সূরা নাবা, আয়াত ৯
মূল উৎস: কিভাবে ভালো ঘুমানো যায়, পৃষ্ঠা ১–৫
আপনার কমেন্ট