সোমবার ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ - ১২:৪১
পশ্চিমা ও পশ্চিমাদের দোসর আরবদের বিশ্বাস করাই আসাদের জন্য কাল হয়েছে

হাওজা / সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিজয় এবং বাশার আল আসাদের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের বিদ্যুৎগতির অগ্রাভিযানের মুখে বাশার আল আসাদের শক্তিশালী ও দানবীয় সামরিক বাহিনীর অবিশ্বাস্য পরাজয় বিস্মিত করেছে পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সব মহলকে। কিছু দিন আগেও বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদের বিজয় হয়েছে, কারণ তিনি তাদের প্রায় দমন করতে সফল হয়েছেন।

বিদ্রোহীরা শত চেষ্টা করেও বাশারের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মনোবল হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বলেও মনে করেছিলেন অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। এমনকি বাশার আল আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তার প্রতিবেশী দেশগুলোসহ অনেক পশ্চিমা দেশও। তবে তাদের সবাইকে অবাক ও অপ্রস্তুত করেছে বিদ্রোহীদের এই আকস্মিক বিজয় অভিযান।

এদিকে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিজয় এবং বাশার আল আসাদের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে। কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছে এসব প্রতিবেশী রাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে বাশার আল আসাদের পতন তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে তা নিয়ে এই প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার, কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাশার আল পতনের ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে যে সব দেশ তাদের মধ্যে অন্যতম ইসরায়েল। সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্ত দাঁড়িয়ে আছে গোলান মালভূমিতে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই গোলান মালভূমির অধিকাংশই সিরিয়ার থেকে দখল করে নিয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্রটি।

এর পর থেকেই সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অবস্থান করছে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্ব। পাশাপাশি লেবাননে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ইরানপন্থি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর যোগাযোগের মাধ্যমও সিরিয়া। সিরিয়ার ভূখণ্ড ব্যবহার করেই হিজবুল্লাহর জন্য প্রয়োজনীয় রসদসহ অন্যান্য সাহায্য প্রেরণ করে থাকে ইরান।

এ পরিস্থিতিতে বাশার আল আসাদ পতনের প্রেক্ষিতে সিরিয়ার ভবিষ্যত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে স্বভাবতই তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে বাশার পরবর্তী সিরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বে কারা আসীন হবে তাদের মনোভাবের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ বোঝাপড়া।

বাশারবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ইসলামপন্থি এবং রক্ষণশীল মতাদর্শের হওয়ায়, তাদের মধ্যে কেউ যদি সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করে তবে স্বভাবতই তা ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন ইহুদি রাষ্ট্রটির বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক মহল। এই উদ্বেগ ফুটে উঠছে দেশটির গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও।

ইসরায়েলের প্রভাবশালী গণমাধ্যম জেরুজালেম পোস্টে রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও উঠে আসে তাদের এই উদ্বেগের বিষয়টি। সেখানে বলা হয়, বাশার আল আসাদের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি খুবই মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী। পাশাপাশি সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত গোলান মালভূমিতেও সতর্কতামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।

বিশেষ করে বাশার আল আসাদের সামরিক বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া শূন্যতার সুযোগ নিয়ে যেন ইরান ও হিজবুল্লাহ বাশার বাহিনীর হাতে থাকা বিভিন্ন ধরনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, জঙ্গিবিমান ও বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র হস্তগত করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ রয়েছে ইসরায়েল।

পাশাপাশি বাশার আল আসাদের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারও একটি সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরা হয়েছে জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদনে।

সেখানে ইরান সম্পর্কে বলা হয়, ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের বিষয়টি হজম করাটা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। তারা এখন বোঝার চেষ্টা করছে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা।

এ পরিস্থিতি ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে, নাকি পরমাণু কর্মসূচি বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাবে, যেন চার বছরের শাসনামলে ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে তেহরান, ইসরায়েল মনে করছে এখন এই দুটির একটিকে বেছে নিতে হবে ইরানকে। পাশাপাশি বাশার আল আসাদের পতনের পর ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে আটকানোই ইসরায়েলের প্রধান কর্তব্য হবে বলেও তুলে ধরা হয়েছে জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদনে।

অপরদিকে বাশার আল আসাদের পতনের পর তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিজবুল্লাহর ভবিষ্যত খুব একটা ভালো হবে না বলেও উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, হিজবুল্লাহ লেবাননে থেকে বাশার আল আসাদের পক্ষে তৎপরতা চালাবে কি না সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়।

তবে তা করলে সিরিয়ার বাশার বিরোধীদের টার্গেটে পরিণত হবে শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এমনকি হিজবুল্লাহকে শায়েস্তা করতে প্রয়োজনে লেবাননের রাজধানী বৈরুত অভিমুখেও বাশার বিরোধীরা অভিযান চালাতে পারে এমন ভবিষ্যত চিত্রও উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। এছাড়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়ে হিজবুল্লাহর সক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। তাই হিজবুল্লাহ বরং নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে না জড়িয়ে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করবে।

বাশার আল আসাদের পতনের পর জর্দানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর ক্ষমতার মসনদও ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয় জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদনে। সিরিয়ার অস্থিরতা জর্দানকে আন্দোলিত করলে তা ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে উঠে আসে সেখানে।

বিশেষ করে এই মুহূর্তে জর্দানের বর্তমান হাশেমি শাসকদের বিরুদ্ধে দেশটির বিভিন্ন গোষ্ঠীর অসন্তোষ রয়েছে উল্লেখ করে যেকোনো সময় তা বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদন। এছাড়া জর্দান অস্থিতিশীল হলে তা ইসরায়েলের নিরাপত্তাকেও আক্রান্ত করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সীমান্ত রয়েছে জর্দানের সঙ্গে। একই সঙ্গে জর্দানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা সব প্রতিবেশীদের সীমান্তের মধ্যে জর্দানের সীমান্তই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ।

যদি সিরিয়ার অস্থিরতা জর্দানেও ছড়ায় তবে জর্দানের সীমান্তও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।

অপরদিকে বাশার আল আসাদ পরবর্তী সিরিয়ার পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। জেরুজালেম পোস্টের মতে, সিরিয়ার বাশার বিরোধী সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বরং সাম্প্রতিক সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকেও নজর দিতে পারে, এতে সৌদি আরবসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

সবশেষ সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি হতে পারে সে ব্যাপারে জেরুজালেম পোস্টের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে কৌতূহল উদ্দীপক কিছু বিষয়। বর্তমানে জর্দান, সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্ত যেখানে মিলিত হয়েছে সেই আল তানফে সীমিত সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে যেকোনো মূল্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার বাশারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়াতে চাইবে বলে উঠে এসেছে জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদনে। পাশাপাশি বাশারের পতনের পূর্ব থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক মহলের অনেকেই সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলেও উঠে আসে এ প্রতিবেদনে।

তবে ইসরায়েলি এই পত্রিকার মতে, এই ধরনের প্রত্যাহার এই অঞ্চলে মার্কিন দুর্বলতা প্রকাশ করবে। এতে নিকট ভবিষ্যতে জর্দানও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর টার্গেটে পরিণত হতে পারে। সবশেষ সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা বিভ্রান্ত ও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

সূত্র: দ্য জেরুজালেম পোস্ট

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha