সোমবার ১৪ এপ্রিল ২০২৫ - ১৪:১৩
গাজা: যেখানে একটি টুইটও ক্ষেপণাস্ত্রের যোগ্য

ঘাম আর রক্ত একসঙ্গে কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ছে, মাথার উপর বড় বড় মাছি ভনভন করছে। নিজেকে এক টুকরো মাংসের মতো মনে হচ্ছে। মুখ এত শুকনো যে জিভও নড়াতে পারছি না।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজায়, মৃত্যু এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে কেউ আর তাতে ভয় পায় না। এখানে শিশুরা পোড়া পুতুল নিয়ে খেলে, হাসপাতালগুলো রেড ক্রসের তাবুতে পরিণত হয়েছে, আর প্রতিটি টুইট হতে পারে একজন মানুষের শেষ বার্তা। ধ্বংসস্তূপের মাঝে বেঁচে থাকার এক হৃদয়বিদারক বর্ণনা—

ঘাম আর রক্ত একসঙ্গে কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ছে, মাথার উপর বড় বড় মাছি ভনভন করছে। নিজেকে এক টুকরো মাংসের মতো মনে হচ্ছে। মুখ এত শুকনো যে জিভও নড়াতে পারছি না। একটুখানি শুকনো পচা রুটির জন্য মনটা কাঁদে।

ইশ! কাল যদি ইয়াহিয়া আনা রুটিগুলো খেয়ে নিতাম—এক বস্তা শুকনো রুটি এনে বলেছিল, “মিসরের সীমানা থেকে কষ্ট করে এনেছি।” ওষুধের কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন চোখে পড়ল তার দুই ছেলে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো, পেছনের ভ্যানে করে নিজ বাড়ির ধ্বংসাবশেষে কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছে।

শুনেছি, তার ছেলে আগের মাসের বোমাবর্ষণের পর থেকে নিজের ঘরের খোঁজ করত আর মেয়ে—যার এখন আর কোনো খোঁজ নেই—সে তার পুতুলগুলোর জন্য কাঁদত। ইয়াহিয়া কাঁদেনি—তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। শুধু একটি পুরোনো জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে, যা সে বলেছিল এক ইসরায়েলি মরদেহ থেকে নিয়েছে, সপ্তাহজুড়ে দিনে এক টান করে চলছে।

একটা মশা চোখে ঢুকে পড়ল, জ্বালা করছে। কয়েক মিনিট ধরে আমি ঐ লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম—তার হাত কাটা, রক্ত ফোয়ারার মতো বেরোচ্ছে। দুই-তিন বছর আগে হলে হয়তো বমি করে ফেলতাম আর চিৎকার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। কিন্তু এখন শুধু বলি, “শিরাগুলো পুড়িয়ে দাও, আর কিছুটা কাপড় বেঁধে দাও।”

তারপর নিজের ভিতরেই হেসে ফেলি—‘বোধশূন্যতা!’ কেউ যেন ফিসফিসিয়ে বলল, “পরিবার, বন্ধুদের মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপে ঘুমানোই তো বোধশূন্যতা।”

ক্লান্ত আমি, শুয়ে পড়ি। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকি—বিচ্ছিন্ন কয়েক দিন ধরে, বিদ্যুৎ নেই। রেড ক্রসের কাছে কিছু ভবনের দিকে যেতে হবে চার্জ দিতে।

তিন দিন আগে লিখেছিলাম, “গাজায় আমরা গণহত্যার সাক্ষী হচ্ছি—হয়তো এমন কিছু যা তার চেয়েও ভয়ংকর, যার নাম জানি না। হে আরব সাহসীরা! শুধু পেট মোটা করো, ধিক্কার!”

কিছু লাইক, দু-একটা কমেন্ট। তারপর চলে যাই গুরুতর আহতদের কাছে—যাদের হাত-পা কাটা, আর এক মা যার পাঁচ মাসের গর্ভপাত হয়েছে। বাচ্চার বেঁচে থাকার আশা ছিল না।

ঠিক সেই জায়গাটাতেই কয়েকটা ক্ষেপণাস্ত্র পড়ল, যেখানে আমি টুইট করেছিলাম।

হাসলাম—মানে, একটা টুইটও কি ক্ষেপণাস্ত্রের যোগ্য?

‘হাসপাতাল’ থেকে বেরিয়ে আসি—আসলে ওটা হাসপাতাল না, একটা রেড ক্রসের লাল-সাদা তাবু, যার এক পাশ আগুনে পোড়া। ডাক্তারদের সরঞ্জাম বলতে কেবল একটা স্টেথো ছিল, সেটাও গত সপ্তাহে ফেলে দিয়েছি। কী করব ওটা দিয়ে? কার হার্টবিট শুনব? যদি শোনাও যায়, তো কী? একজন বাবা-মা যাদের ছোট্ট সন্তান চোখের সামনে পুড়ে যায়, তারা শুধু তার ওপর মাটি ছিটিয়ে দিতে পারে।

এক সময় তারা কম্বল, কার্পেট, ঠান্ডা পানি—সবকিছু পেত। এখন কেবল পোড়া মাটি।

স্ট্রোক? এটা তো কৌতুক। এখানে শুধু অঙ্গচ্ছেদ আর শরীর ফাটার গল্প।

সূর্য উঠে না, যেন পুড়িয়ে দেয়। কিছু বাচ্চা খেলা করছে—তাদের মন দিয়ে দেখি। যদি ক্ষেপণাস্ত্র লাগে, যেন জানতে পারি কোন তাবু থেকে এসেছে, কার ছেলে-মেয়ে। যেন চট করে শনাক্ত করা যায়।

এই দিনগুলোতে মৃত্যু আমাদের সঙ্গী।

কাল সাঈদ বলছিল, “আমি আবুল ফাতেহকে দিনভর বারবার দেখি—হয়তো আর এক ঘণ্টাও থাকবে না।”

আজ কিছু পাতা জোগাড় করতে হবে। নাহ, হয়তো লেবানন বা মিসরে চলে যাব, একটু কান্নাকাটি করতে। আমার আর কিছু করার নেই।

যখন ওষুধ নেই, তখন আহত হওয়াটাই আল্লাহর আজাব। তখন শুধু বসে থাকা, রক্তক্ষরণে মারা যাওয়া, আর আল্লাহকে বলা—“আমাকে মেরে ফেলো”।

আমার সাদা পোশাকটা ছুঁড়ে ফেলি—রুকাইয়ার পোড়া টেডি বিয়ারের পাশে। কাল সে চিৎকার করে কাঁদছিল—চোখ দুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসছিল, শুধু বলছিল, “আমার পুতুলটা চাই।”

আমি যখন ওর হাতে পুতুলটা দিই, তখনও কাঁদে, বলে—“কেন আমি আমার পুতুলটা দেখতে পারছি না?”
আমি কীভাবে বলতাম—তুই অন্ধ হয়ে গেছিস?

অতএব কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে আঘাত করল, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল।

মিসাইলের শব্দ শুনি, আশ্রয় খুঁজছি। কিন্তু চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ। কোনো ঘর নেই। এই জায়গাটা এক সময় ছিল রাস্তা, চত্বর—এখন মরুভূমি। ১০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

ইশ! আমি যদি একটা কুকুর বা বিড়াল হতাম, কোনো ইংরেজের ছাদের ওপরে, তাহলে হয়তো পুরো দুনিয়া আমার জন্য কাঁদত।
অথবা যদি আমার চুল স্বর্ণালী হতো, চোখ নীল—তাহলে সবার দয়া পেতাম।

মিসাইলের সাঁই সাঁই শব্দ আবার আসে। পা জড়িয়ে যায়, শরীর পুড়ছে। মনে হচ্ছে উপরে যাচ্ছি। নিচে অনেক মানুষ, সবাই আমাকে দেখে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছে।
মনে হয় পেট ভরেছে—লোহার মতো কিছু খেয়েছি? মিসাইলটা গিলে ফেললাম?

শহর আবার শহর হয়ে উঠছে, শিশুদের হাসি শোনা যাচ্ছে। কান্নার কোনো শব্দ নেই। কোনো মা-বাবার আহাজারি নেই।

একজন পুরুষ যদি আহাজারি করে—তাহলে বুঝতে হবে, সে সব হারিয়েছে। এমনকি তার অহংকারও রসিকতা হয়ে গেছে।

সবাই এত খুশি কেন? মনে হচ্ছে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ছি।

আহ! রক্ত ঝরছে। কিন্তু ব্যথা কেন লাগছে না?

হৃদপিণ্ড কেন ধুকপুক করছে না?

রিপোর্ট: হাসান রেজা 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha